


মহান
ত্যাগী পূজনীয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বন ভন্তে) মহোদয়ের মুখনিঃসৃত বাণীবন ভন্তের
দেশনা শিরোনামের এ গ্রন্থখানা সৌজন্য কপি হিসেবে সবিনয়ে আপনাকে অর্পন করলাম।
এ সৌজন্য পুস্তক
দানের পূণ্য প্রভাবে জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক এবং আমাদেরও নির্বাণ লাভের হেতু হোক।
গভীর শ্রদ্ধান্তে-
ডাঃ অরবিন্দু বড়ুয়া
(সংকলক)
ও সজল কান্তি বড়ুয়া
(প্রকাশক)
বন ভন্তে দেশনা
(১ম
খন্ড)
গ্রন্থনায়ঃ
ডাঃ অরবিন্দু বড়ুয়া
প্রকাশনায়ঃ
সজল কান্তি বড়ুয়া
প্রকাশকালঃ
বুদ্ধ পূর্ণিমা ২৫৩৭ বুদ্ধাব্দ
১ম
সংস্করণঃ ১৪০০ বাংলা ২৩শে বৈশাখ
এ গ্রন্থখানা রচনায় যাঁরা বিভিন্নভাবে অকৃপণ
সহযোগিতা এবং শ্রম দিয়েছেনতাঁদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা গেল।
পরলোকগত বাবু জ্যোর্তিময় চাকমা (অবঃ ম্যাজিষ্ট্রেট)
বাবু নির্মলেন্দু চৌধুরী বাবু সুরেশ বড়ুয়া,
বাবু কনক কুসুম বড়ুয়া
লোও বাবু সুধীর কান্তি দে।
প্রচ্ছদঃ
বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা
মুদ্রণ
তত্বাবধানেঃ
বাবু বিজয় কৃঞ্চ বড়ুয়া
প্রযত্নে
প্রজ্ঞা প্রিন্টার্স
২৬,
মোমিন রোড, চট্টগ্রাম।
কম্পিউটার
কম্পোজঃ রাহুল কম্পিউটার
৪১,
কাটাপাহাড় লেইন, টেরীবাজার, চট্টগ্রাম।
ফোনঃ
২২০৯৬২
উৎসর্গ
পরম কল্যাণ মিত্র ও
ধর্মাচরণে সতীর্থ
পরলোকগত বাবু জ্যোর্তিময় চাকমা
(অবঃ ম্যাজিষ্ট্রেট)
মহোদয়ের পূণ্য স্মৃতি
স্বরণে এবং আমাদের
পরলোকগত
জ্ঞাতিগণের
উদ্দেশ্যে ‘‘বন
ভন্তের দেশনা’’
নামক গ্রন্থখানা
উৎসর্গ করলাম।
-সংকলক ও প্রকাশক।
ভূমিকা
গুণীরা গুণীর গুণ বঝে সর্বক্ষণ।
অগুণী গুণীর গুণ না বুঝে কখন।।
ডাক্তার
শ্রীযুত বাবু অরবিন্দ বড়ুয়া আয়ুষ্মান বন ভিকখু শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবিরের যে
সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাঁর দেশনা লিখেছেন, সেই পান্ডুলিপিটি আমি আদ্যন্ত পাঠ করে পরম
প্রীত হয়েছি। তাঁর লিখার ভাবভঙ্গী বড়ই সাবলীল, সহজবোধ্য ও যুক্তি উপমা সমুহ
সহজতর।
শ্রীমৎ
সাধনানন্দ মহাস্থবির মহোদয় মহাগুণ জ্ঞানী মহাপুরুষ। ডাক্তার অরবিন্দ বাবু তাঁকে
বিশেষ ভাবে জেনেছেন ও বুঝেছেন। যেহেতু তিনিও গুণী। গুণীর গুণ গুণীরাই বুঝতে পারেন,
নিগুণীরা তা বুঝতে পারেনা। তাই জ্ঞানী সমাজে ডাক্তার বাবু ধন্যবাদ ও প্রশংসাবাদ
প্রাপ্তির উপযুক্ত ব্যক্তি বলে আমি মনে করি।
বন
ভিক্খুর গুণ প্রকটার্থ তিনি যা লিখেছেন তা বড়ই আশ্চর্য ও চমৎকার বুদ্ধির পরিচয়
দিয়েছেন। বনভিকখুকে একজন বুদ্ধ প্রশংসিত ভিকখু বললেও অত্যুক্তি হয়না। তখনকার
কালে অনেক ভিকখু বুদ্ধের নিকট হতে কর্মস্থান শিক্ষা করে গভীর অরণ্যে বাস করতঃ
প্রব্রজ্যাকৃত্য সমাপন করে সার্থকতা সম্পাদন করতেন। বর্তমানকালেও বন ভিকখুও
তৎকালীন প্রিয়শীল ভিকখুগণের অনুকরণ করে দীর্ঘদিনব্যাপী মহারণ্যে সাধনায় রত থেকে
স্বীয় জীবনকে সাফল্য মন্ডিত করেছেন। এ যাবৎ বহু সজ্জন মন্ডলীকে তাঁর অনুকরণে গঠিত
করে আদর্শ স্থান লাভ করছেন। ইহা তাঁর বহু মঙ্গলময় ব্যাপার।
এ
সংক্ষিপ্ত জীবনীতে ডাক্তার বাবু বন ভিকখুর যে বিষয়বস্তু সমূহের উল্লেখ করেছেন
তাতে অলৌকিক বিষয়েরও বহু ঘটনাবলীর বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অলৌকিক জ্ঞান
চিন্তা সাপেক্ষ। তিনি প্রয়োজন বোধে অনেক বিষয় চিন্তা করে অনেক স্থানে অনেক কিছু
বলেছেন, তা দেখেও অনেক শ্রদ্ধাবানদের শ্রদ্ধা আরো বর্ধিত হয়েছে। মার্গফল লাভ না
হলে কেহ উক্তরূপ চিন্তা করতে সক্ষম হননা। ডাক্তার বাবুর লিখা বর্ণনায় দেখা যায়
বন ভিক্খু কারো প্রতি কোন সময় কর্কশ বাক্য ব্যবহার করলেও লোভ দ্বেষ, তুচ্ছ ও
তাচ্ছল্যতা বশে ব্যবহার করেন নাই। তা’ শিক্ষা ও মঙ্গলের জন্যই বলেছেন, অমঙ্গলের জন্য নহে। ভাল,
ভদ্র, বিনম্র ও মেধাবী ছাত্রকে প্রহার করতে হয়না। তারা স্বল্প কথাতেই শিক্ষা লাভ
করে ভবিষ্যত ফল শুভ ফলপ্রদ করে নেয়। আর অবাধ্য ও উগ্র স্বভাব বিশিষ্ট ছাত্রকে
প্রহারাদি করে শিক্ষা দিতে হয়। এর ফলে তারও ভবিষ্যৎ ফল শুভপ্রদ হয়। বন ভিকখুও
অবস্থাভেদে শিক্ষার জন্যেই কৃচিৎ অগত্যা কর্কশ বাক্যাদি ব্যবহার করেন মাত্র।
অরবিন্দু
বাবু লিখার মাধ্যমে বন ভিকখুর যে পরিচিতি দিয়েছেন, তদ্বারা বহুগুণগ্রাহী, ভিকখু,,
শ্রমণের, গৃহী, আবালবৃদ্ধবণিতাদের প্রভূত উপকার সাধন হবে বলে আমি মনে করি। যেহেতু
হিতকল্যাণময় বিষয়বস্তু বহুলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তার মাধ্যমে।
তিনি
প্রত্যেক সন্দর্ভের পর স্বীয় মন্তব্যরূপে দুই লাইনের একটি পদ্য রচনা করে
দিয়েছেন। সে পদ্য সমূহের শব্দ বিন্যাস অতি সরল ও সহজবোধ্য, কিন্তু ভাব অতিশয়
পরমার্থভাব গাম্ভীর্যে সমৃদ্ধ। তাই তিনি ভাব কবিত্বেরও দাবীদার বল্লে অত্যুক্তি
হবেনা। তাঁর রচিত আরো বহু কবিতার পান্ডুলিপি আছে, তাও ভাবগাম্ভীর্যে কল্যাণপ্রদ।
অরবিন্দ
বাবুর বিরচিত বন ভিকখুর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও উপদেশ নির্মাল্য পুস্তিকাটি গৃহী,
আবালবৃদ্ধবণিতা ও ভিকখু শ্রমণদের প্রত্যেকে বার বার পাঠ করলে সবাই উপকৃত হবেন বলে
আশা করি।
তিনি
আরো সুস্থ শরীরে দীর্ঘয়ু লাভ করতঃ বুদ্ধ শাসনের তথা বৌদ্ধ সমাজের মহা উপকার করার
জন্য কায়মনোবাক্যে কামনা করছি। তার আদর্শ অত্যন্ত সৎ ও কল্যাণপ্রদ।
সর্বসত্ত্বের প্রতি হিতকামী-
স্বাক্ষরঃ- জিন বংশ মহাথেরো
মহামনি মহানন্দ সংঘরাজ বিহারাধ্যক্ষ
গ্রামঃ পোঃ
মহামুনি, চট্টগ্রাম।
২৬/২/১৯৮৯ইং

আশীষ বাণী
ধর্মবোধ অর্জনে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। কেহ যদি ধর্মজ্ঞান
লাভ করেন তা’ প্রকাশ করার
মাধ্যম একমাত্র ভাষাই, সে ভাষা মৌখিক হোক অথবা লিখিতই হোক, বুদ্ধের সমকালে
ত্রিপিটক গ্রন্থের জন্ম না হলেও মুখের ভাষাই ছিল জীবন্ত। তখনকার দিনে অন্যের কাছ
থেকে শ্রবণ করেই অসংখ্য নরনারী ধর্ম্ম দর্শন লাভ করেছেন। তাই ভাষাজ্ঞানের গুরুত্ব
কিছুতেই কম নয় গ্রন্থ সংকলন করাটা ভাষাজ্ঞানের সাহায্যে। ধর্ম্মজ্ঞানকে
পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরা। সে একই উদ্দেশ্য নিয়ে ডাঃ অরবিন্দ্র বড়ুয়া সাধকের
জীবন কাহিনী এবং শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের দেশনা হতে সামর্থানুযায়ী আহরিত শিক্ষনীয়
বিষয় গল্পকারে সংকলন করে এ গ্রন্থখানা সদ্ধর্মপ্রাণ মুক্তিকামী উপাসকগণের নিকট
উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তার এই প্রচেষ্টায় অনেকেই উপকৃত হবে বলে মনে করি।
তিনি শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের একজন
বিশিষ্ট উপাসক। ত্যাগের মহিমায অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সংস্পর্শে এসে
যা উপলব্ধি করেছেন সেই সত্যটুকুই তিনি বন ভন্তের দেশনাকারে সম্পাদন করেছেন। শ্রদ্ধাবান
এবং বিশ্বাসীদের নিকট আর্য্যসত্য প্রকাশের জন্য তার এ মহৎ উদ্দেশ্য- যদিও তিনি
লেখক কিম্বা গ্রন্থকার নন, তবুও তার এ বইখানা ভবিষ্যতে অনেকের উপকার সাধন করবে
সন্দেহ নেই। পাঠক মহল আশা রাখে অরবিন্দ বাবুর কাছ থেকে চারি আর্য্যসত্যের
বিশ্লেষণক্ষম আরও ধর্ম গ্রন্থ যেন ভবিষ্যতে লাভ করা যায়।
লেখক যে ভাবে নিজের অভিজ্ঞতা
দ্বারা মহা মনীষী সাধকদের প্রচারিত আয্যসত্যের সহজ, সরল প্রকাশনা মুক্তকামীদের
হাতে অর্পণ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাতে মুক্তিকামী সকলে নিশ্চয়ই চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
সব্বে সত্ত্বা সুখিতা হোন্তু।
ইতি-
আশীর্বাদান্তে
স্বাক্ষরঃ- শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার ভিক্ষু
তাংঃ ৪-২.৮৯ইং
রাজ বন বিহার, রাঙ্গামাটী।
শুভেচ্ছা বাণী
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের বাণী এবং বন ভন্তে ও বন বিহার
সম্পর্কিত নিদর্শন সমূহসংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনেকদিন ধরে অনুভব করছিলাম। বন
ভন্তের ন্যায় জ্ঞানী ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা আমাদের অত্যন্ত সৌভ্যগ্য। এখন থেকে
বন ভন্তে সম্পর্কিত তথ্য সমূহের সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ
বংশধরদের প্রতি আমাদের অন্যায় করা হবে। “বন ভন্তের সংক্ষিপ্ত জীবনীও তাঁহার দেশনা” নামক এই প্রকাশনাটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
বইটি ছাপানোর আগে কয়েকটি
অধ্যায় পড়ে দেখলাম যে লেখক বাবু অরবিন্দু বড়ুয়া সহজ, সরল, সুন্দর ভাষায়
বনভন্তের দেশনা সমূহ ব্যাখ্যা করেছেন। বন ভন্তের জীবনীর ব্যাপারেও কয়েকটি বিরল
তথ্য উথাপন করা হয়েছে। বইটি নিঃসন্দেহে পাঠক মহলে সাদরে গৃহীত হবে।

২৩-১-৮৯ইং
শুভেচ্ছা বাণী
পরম আর্য পুরুষ শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির
(বন ভন্তে) মহোদয়ের উপদেশ অবলম্বনে ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়া (হোমিওপ্যাথ) মহাশয়ের
লেখনী ধারণ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করার উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। দীর্ঘদিন আগে
থেকে এ ধরণের প্রয়াস গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হচ্ছিল। এ সংকলনটি প্রকাশিত
হওয়ার মাধ্যমে সেই অভাব পূরণের কিছুটা সহায়ক হবে।
ডাঃ বাবু রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সান্নিধ্যে ধর্মোপদেশ শ্রবণের সুযোগ পেয়েছেন। বহুদিন হতে সেই
ধর্মোপদেশ সমুহকে ভিত্তি করে এ হেন সংকলন প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করে আসছিলেন। তাঁর
সেই মহান সদিচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে দেখে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুবই আনন্দ বোধ করছি।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের মুখনিঃসৃত ধর্মোপদেশ লেখনীতে ধারণ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা
কঠিন কাজ হলেও দীর্ঘ দিনের প্রয়াসের সার্থক যথাযথরূপে ডাক্তার বাবুর পক্ষে তা
সম্ভব হয়েছে। তার এ মহান উদ্যোগে ধর্ম পিপাসুরা বিশেষ উপকৃত হবেন এবং ভবিষ্যৎ
প্রজন্মও এতে উপকৃত হবেন। অধিকন্তু উহা শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের মুখনিঃসৃত বাণী
প্রচারে বিশেষ সহায়ক হবে।
আমি তার উদ্যোগের সর্বাঙ্গীন
সাফল্য কামনা করি।
সকল প্রাণী সুখী হউক।
সুনীতি
বিকাশ চাকমা
সভাপতি
রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটি,
রাজবন বিহার, রাঙ্গামাটি।
তারিখঃ-২৭-২-৯৩ইং
প্রচার,যোগাযোগ ও প্রকাশনা
দপ্তর থেকে
শ্রদ্ধেয় “বন ভন্তের
দেশনা” গ্রন্থের লেখক ডাঃ
অরবিন্দ বড়ুয়া রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটির স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের একজন
সক্রিয় সদস্য। গ্রন্থকার শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের একনিষ্ঠ শ্রদ্ধাবান উপাসক হিসেবে
প্রায়ই রাজবন বিহারে তিথি অনুসারে উপোসথ পালন করেন ও মহান ত্যাগী জ্ঞান সাধক
শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বন ভন্তে) এর দেশনা শ্রবণ করেন। তিনি তাঁর
সাধ্যানুযায়ী শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের মূল্যবান দেশনা শ্রবণ করে যতটুকু পারেন তা
গ্রহণ, ধারণ ও অনুশীলন করার চেষ্টা করেন। বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন ধর্মীয়
স্মরণিকায় এবং বিশেষ পত্র পত্রিকায় তিনি চতুর্দশ পদী
ধর্মীয় কবিতাও লিখেছেন। তিনি বন ভন্তের মুখনিঃসৃত বাণীও লিপিবদ্ধ করেন।
সংগৃহীত বাণীই গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ। তার নিজ জ্ঞানের পরিধিতে বন ভন্তের
সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাঁর দেশনা পুস্তকে যা লিপিবদ্ধ করেছেন আমার মনে হয় সদ্ধর্ম
প্রাণ উপাসকউপাসিকার বহু উপকার সাধন করবে। উক্ত পুস্তকের অনেকগুলো দেশনা আমি নিজেও
শ্রবণ করেছি। লেখকের লেখনী হউক আরও সচল এ কামনা করি।
আরও আনন্দের বিষয় যে, এ পুস্তক
প্রকাশ করতে আগ্রহী প্রকাশক বাবু সজল কান্তি বড়ুয়া মহোদয়ের উদ্যোগ ও কর্মের
প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় এবং তিনি এ পুস্তক প্রকাশ করে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ
নিয়েছেন। এ গ্রন্থের বহুল প্রচার সদ্ধর্ম প্রাণ ব্যক্তিবর্গের লোকোত্তর জ্ঞান
লাভের সহায়ক হবে এ প্রত্যাশা করি।
পরিশেষে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের
আদর্শের অনুসারীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ যদি কোন শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকা "বন
ভন্তের দেশনা” বহুল
প্রচারণার্থে পুনঃ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক গ্রন্থকারের অনুমতি সাপেক্ষে বিনামূল্যে
সৌজন্য কপি হিসেবে পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন।
স্বাক্ষরঃ- সজ্জিত কুমার চাকমা
প্রচার সম্পাদক
রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটি
তাং-৯-৭-৮৯ইং
|
(লেখকের কথা)
পরম পূজনীয় বন ভন্তে লংগদুর তিনটিলায় থাকাকালীন ১৯৭০ ইংরেজী.... তাঁর
প্রথম দর্শন লাভ করি। মধ্যে মধ্যে তাঁর লোকোত্তর দেশনা শ্রবণ করার জন্যে সেখানে
যেতাম। এমন কি বন ভন্তের প্রধান দায়ক বাবু অনিল বিহারী চাকমার (হেডম্যান) বাড়ীতে
কয়েকদিন পর্যন্ত অবস্থান করতাম। তার দেশনাগুলো এতই গভীর যে সামান্য মাত্রও বুঝে
অত্যন্ত প্রীতি অনুভব করতাম। সে সময় হতে তাঁর দেশনা লেখার জন্য মনে উদয় হলেও
সাহস পেতাম না।
১৯৭৪ ইংরেজীতে যখন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে রাজবন
বিহারে পদার্পণ করেন তখন হতে প্রায় নিয়মিতভাবে তাঁর দেশনা শুনতাম কিন্তু তাঁর
দেশনাগুলো প্রাঞ্জল হওয়া সত্বেও আমার পক্ষে কঠিন ও সংক্ষেপ বিধায় হৃদয়ঙ্গম করা
খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল।
১৯৭৮ ইংরেজীতে আমি চিন্তা করলাম বন ভন্তের
দেশনাগুলো যথাযথভাবে লিখতে পারলেও সামান্যটুকু বুঝে সামান্য জ্ঞানের পরিধিতে দেশনা
লেখা একান্ত দরকার এ মনোভাব পোষণ করে একদিন তাঁর নিকট আশীর্বাদ প্রার্থনা করে
চতুঃদশপদী কবিতা এবং গদ্যাকারে তাঁর দেশনাগুলো লিখতে আরম্ভ করি।
একদিন বন ভন্তে আমাকে বললেন-তুমি আমাকে
কিভাবে দর্শন কর জান? উত্তরে বললাম-না ভন্তে। তিনি বললেন-সূর্য্য ডুবন্ত
অবস্থায় বা সন্ধ্যার সময় অনেক দূর হতে কোন লোক অন্য লোককে অস্পষ্ট ভাবে দর্শন
করে, তদানুযায়ী তুমি আমাকে দর্শন করে থাক। বাস্তবিক পক্ষে তাঁর দেশনাগুলোও আমার
পক্ষে সামান্য দর্শন মাত্র।
সামান্য দর্শনে ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে বেশী।
সে জন্য শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করতেছি। পাঠক-পাঠিকার প্রতি
আমার ভুল ত্রুটিকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। বিগত দশ বছরে বিভিন্ন
সময়ে ও বিভিন্ন উপলক্ষে তার দেশনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। অনেকস্থানে নাম ঠিকানা না
জেনেও উদাহরণ স্বরূপ লিখেছি। সামান্যতম লিখায় যদি কারও উপকারে আসে আমি সে পূণ্যের
অধিকারী হবো আশা করি। এ পূণ্যের প্রভাবে ভবিষ্যতে দেশনাগুলো আরও যথাযথ ভাবে লিখে
দ্বিতীয় খন্ডে লিপিবদ্ধ করার পরিকল্পনা রইল।
...................................................................................................................................................................................................................................................................................।
এই বইয়ের ব্যাপারে বন ভন্তের একনিষ্ঠ উপাসক পরলোকগত
শ্রদ্ধেয় দাদা
বাবু জ্যোতির্ময় চাকমা (অবঃ ম্যাজিষ্ট্রেট) মহোদয় আমায় ভূল ত্রুটি সংশোধন করেছেন। তজ্জন্য তাঁর প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও শাহ উচ্চ
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু নির্মলেন্দু চৌধুরী মহোদয়ের পরামর্শ ও আমার লেখার
ভুল সংশোধনের জন্য তার কাছে অনেকাংশে ঋণী। রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বালিকা
বিদ্যালয়ের সুযোগ্য শিক্ষক বাবু সুরেশ বড়ুয়া হতে লেখার সাহায্য পেয়ে তাঁকে
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। বন ভন্তের শ্রদ্ধাবান উপাসক স্নেহের সজল কান্তি বড়ুয়া উক্ত
পুস্তক প্রকাশ করায় পাঠক-পাঠিকাদের মহোপকার সাধন করেছে। এ পূণ্যের প্রভাবে তার
নির্বাণ লাভের হেতু হোক।
পরিশেষে পাঠক-পাঠিকাদের নিকট আশীর্বাদ
প্রার্থনা-আমি যেন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে দূর হতে সন্ধ্যার সময় অস্পষ্ট দর্শনের
পরিবর্তে অতি সন্নিকটে মধ্যাহ্ন সময়ে সুষ্পষ্টভাবে দর্শন করে তার নির্দেশিত পথ
অনুসরণ করে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত অতিবাহিত করতে পারি এবলে আমার দুটি কথার
পরিসমাপ্তি করলাম।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।
বিনীত
নিরাময় হোমিও নিকেতন
অরবিন্দু বড়ুয়া
তবলছড়ি বাজার, রাঙ্গামাটি
তাং-৩-২- ৯৩ইং
![]() |
বিঃ দ্রঃ-পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ শ্রদ্ধেয় “বন
ভন্তেরদেশনা”নামক এই গ্রন্থখানা পাঠ করে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত জ্ঞাপন করলে
উৎসাহ বোধ করব এবং ভবিষ্যতে দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশকরার উদ্যোগ গ্রহণ করব।
প্রকাশকের কথা
রাঙ্গামাটির
প্রাণকেন্দ্র রাজবাড়ীর অতি সন্নিকটে প্রায় চতুর্দিকে জলবেষ্টিত ষোল একর বন
ভূমিতে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে রাজবন বিহার অবস্থিত। পাহাড়ের স্থানে স্থানে বনরাজীর
ফাঁকে ফাঁকে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের শিষ্যবর্গের বিবেক কুঠির পরিশোভিত প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য্যে বিমন্ডিত রাজবন বিহারে আমি কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে অথবা নিরিবিলিতে
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের মুখ নিঃসৃত অমুল্য ধর্মদেশনা শ্রবণার্থে গমন করি। প্রথমতঃ
রাজবন বিহারের প্রাকৃতিক শোভা দর্শনে বিমোহিত হই। দ্বিতীয়তঃ শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের লোকোত্তর
দেশনা শ্রবণ করে ক্ষণিকের জন্যে চিত্তের প্রসন্নতা লাভ করি । তাতে আমি মনে চিন্তা
করি শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের বাণীগুলো কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় ।
একদিন আমার বড় দাদা
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের একনিষ্ঠ উপাসক ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়ার সহিত বন ভন্তের দেশনা
সম্বন্ধে আলোচনা হয়। কথা প্রসঙ্গে তাঁর লিখিত “বন ভন্তের দেশনা” প্রকাশনার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেন। আমার আকাংখিত বিষয়
অবগত হয়ে প্রকাশনার জন্য সানন্দে সম্মতি জ্ঞাপন করি। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে
টাকা-পয়সা স্পর্শ করেন না বলে তিনি উক্ত পুস্তক বিনামূল্যে সৌজন্য পুস্তক হিসাবে
বিতরণ করার জন্য বিশেষ শর্ত আরোপ করেন। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের আশীর্বাদে এ অমূল্য
গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশনার কাজে উৎফুল্ল চিত্তে নিজেকে নিয়োজিত
করলাম।
অতএব, শ্রদ্ধেয় “বন
ভন্তের দেশনা”
প্রকাশনায় যদি পাঠক-পাঠিকাদের কিঞ্চিৎ মাত্র জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাতে আমার পূণ্য
বীজ বপিত হবে আশা করি। সে পূণ্যের প্রভাবে আমার লোকোত্তর জ্ঞান বা মার্গফল লাভের
হেতু হউক।
বিশ্বের
সকল প্রাণী সুখী হউক।
সকল
দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করুক।।
ইতি-
নিবেদক
-
৬
নং প্রবর্তক পল্লী নাসিরাবাদ বায়েজিত বোস্তামী রোড, সজল কান্তি বড়ুয়া চট্টগ্রাম। তাং-৩-২-৯৩ইংপ্রকাশক
জাতি ভেদাভেদ বৈষম্য হিমাদ্রী-
লংঘিয়াছিল মহান জলধি
সকল বন্ধন করি অবসান
গাওরে সকলে ঐক্য বিতান (২বার)
ছয় রং পতাকার শান্তি নিশান।
জয় জয় বৌদ্ধ
পতাকা -ঐ (৩ বার)
|
বৌদ্ধ সংগীত
জয় জয় বুদ্ধ
পতাকা
অহিংসার বিজয়
নিশান,
গাওরে সকলে
ঐক্য বিতানে,
অহিংসার মহান
মিলন গান।জাগে মহা বিশ্ব সাম্য মৈত্রী সলিলে (২বার)
আকাশে বাতাসে
বন উপবনে
নদী কল্লোল
ধরেছে টান (২ বার)
|
![]() |
(খ)
বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকা উদ্বোধনী সংগীত
এসো সবে মিলি নমো নমো বলি,
নমো নমো ভগবান।
অহংসা পতাকা বুদ্ধের নিশান,
শত শ্বাশত বার মৈত্রীর আঁধার,
বিশ্ব শান্তি প্রেমের বিধান।
ধর্ম পতাকা এ যে মোদের,
সদায় শান্তি একতা নিশান।
আদি অন্ত মাঝে আনিতে কল্যাণ,
নমো নমোহে বিজয় নিশান,
নমো নমোহে বৌদ্ধ নিশান,
পঞ্চ, অষ্ট দশশীল নিবন্ধন।।
|
বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকার ছয় রশ্মির বর্ণনা
আজ হতে শত বৎসর আগে এমনি এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় বিশ্ব
পতাকা উত্তোলন করা হয় শ্রীলংকায়। সেদিন ছিল ১৮৮৫ সনের ২৮শে এপ্রিল। ধর্ম অর্থে
যদি নীতি হয় তাহলে নীতি কোন ব্যক্তি বিশেষ কিম্বা ধর্মকে বুঝায়। সে অর্থে
ধর্মীয় পতাকা নির্ধারণ বৌদ্ধ নীতির পরিপন্থী কিন্তু শ্রীলংকার বিশেষ পরিস্থিতিতে
ধর্মীয় চেতনাকে সমুন্নত রাখার মানসে বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকার উদ্ভব ও উত্তোলন
করা হয়। এ পতাকা সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্যের পূর্ণ প্রতীক। আজ এ বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে
শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকার মানোন্নয়নে সকলের ঐক্যবদ্ধ
প্রচেষ্টার প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা অধিক।
একদা ভগবান বুদ্ধ অনাথপিন্ডিক
নির্মিত জেতবন আরামে বাস করছিলেন। তখন একবার “চারিপাদ ঋদ্ধি” (অলৌকিক শক্তি) প্রদর্শন করেছিলেন। ঋদ্ধি প্রদর্শন কালে
ভগবানের শরীর হতে ছয়রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়েছিল। ছয়রশ্মি যখাঃ নীল, পীত, লোহিতও
দাত, মুঞ্জিষ্ঠা ও প্রভাস্বর।
১)নীলঃ ভগবান বুদ্ধের কেশ রাশি ও চক্ষুদ্বয়ের
নীলবর্ণ স্থান হতে প্রথম জ্যোতি নীল রশি বিচ্ছুরিত হয়েছিল। অনন্ত আকাশের নীল বর্ণ
সদৃশ সর্বপ্রাণীর প্রতি সীমাহীন মৈত্রী পরায়ণতা। ইহা তথাগত বুদ্ধের বিমুক্তির
চিহ্ন। এই নীল রশ্মি মৈত্রী পরামী।
২) পীত বা হলদেঃ সম্যক সম্বুদ্ধের গেরুয়া চীবর হতে দ্বিতীয়
পীত রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়েছিল। ইহা ত্যাগ বা সাধুতা ও বৈরাগ্যের চিহ্ন। এই রশ্মির
অর্থ নৈস্ক্রম্য পারমী।
৩) লোহিত বা লাল রশ্মিঃ তৃতীয় জ্যোতি বুদ্ধের ত্বকের মধ্য হতে বের
হয়েছিল। বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সংসারে জন্ম জন্মান্তর তেজবলে আপন জীবন উৎসর্গ
করেছিলেন। কোন সময় তেজচ্যুত হননি। এর অর্থ তেজবান, ধৈৰ্য্য ও বীরত্বপূর্ণ গুণ। এই
লোহিত বর্ণ বীর্য পারমী।
৪) ওদাত বা শ্বেত বর্ণঃ চতুর্থ জ্যোতি বা শ্বেতবর্ণ সমুদ্ধের ৪০টি
শ্বেতবর্ণ ও দরাজি চক্ষুদ্বয়ের শ্বেতস্থান হতে এই রশ্মি প্রকাশিত হয়েছিল। এর
অর্থ সরলতা ও উদারতা। ইহা দান পারমীর চিহ্ন।
৫) মুঞ্জিষ্ঠা বা কমলাঃ পঞ্চম জ্যোতি মুঞ্জিষ্ঠা
(ঈষৎ লাল বা পাতলা লাল মিশ্রিত হলদে রং) ভগবান বুদ্ধের শরীর ও চীবরের সমন্বিত
প্রতীক' এর অর্থ সাম্য, অহিংসা ও মুক্তি মার্গে উপনীত হবার চিহ্ন। ইহা ক্ষান্তি
পারমী।
৬) প্রভম্বর বর্ণঃ ইহা উপরোক্ত সমস্ত রশ্মির
মিশ্রিত জ্যোতি। উপরোক্ত পাঁচ বর্ণের উজ্জ্বল আলো পর পর পাঁচ বর্ণ যুক্ত রং উপর
থেকে নীচের দিকে যথাক্রমে নীল, পীত, লোহিত, ওদাত ও মুঞ্জিষ্ঠা সজ্জিত। ইহা মহামানব
বুদ্ধের ৩২ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণের চিহ্ন। এই ষড়রশ্মি, দশ পারমী, দশ উপপারমী ও
দশ পরমার্থ পারমী পূর্ণ সম্যক সম্বুদ্ধের প্রজ্ঞা পারমী ।
এ ষড়রশ্মি যুক্ত বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা ভগবান বুদ্ধের
প্রদর্শিত দুঃখ হতে মুক্তি লাভের পথ নির্দেশক। যারা মুক্ত পুরুষ তারা চারি আর্য
সত্য ও জ্ঞানের পতাকা সদৃশ সমুন্নত। যারা জ্ঞানে উন্নত তারাই সুখী। যেই জ্ঞান দুঃখ
বৃদ্ধি কারক সেই জ্ঞান কখনো উন্নত নয়। কাজেই ষড়রশ্মি যুক্ত বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা
জ্ঞানী মানবের সকল দুঃখ বিনাশের প্রতীক স্বরূপ। যারা মুক্তিকামী ও সত্যলাভী তারাই
এই পতাকাতলে আশ্রয় লাভের অধিকারী। দুঃখকে যারা বৃদ্ধি করবে তাঁরা কখনো উন্নত নহে
এবং তাদের দুঃখ হতে মুক্তিলাভ করা সুদূর পরাহত। যারা দুঃখ নাশকারী ও সুখী তারা
দেবমানব সবার উর্ধ্বে।

সূচীপত্র
|
|||||
বিষয়
|
পৃষ্ঠ
|
বিষয়
|
পৃষ্ঠ
|
||
১
|
সাধক শিবচরণ -
|
১
|
২৩
|
নির্বাণ
যাত্রী –
|
৩৬
|
২
|
সাধক যম -
|
২
|
২৪
|
সাধারণ-অসাধারণ-
|
৩৭
|
৩
|
বন ভন্তে প্রশস্তি –
|
৫
|
২৫
|
চিত্তের অনুকূলে দেশনা-
|
৩৮
|
৪
|
মহান
সাধক বন ভন্তের
সংক্ষিপ্ত জীবনী -
|
৫
|
২৬
|
মুক্তির পথে বাঁধা-
|
৪১
|
৫
|
নির্বাণ
গমনের চাবিকাঠি -
|
১১
|
২৭
|
মান এর পরিণতি –
|
৪২
|
৬
|
কঠিন চীবর দানােৎসবে দেশনা
|
১১
|
২৮
|
সদ্ধর্ম ও পরধর্ম -
|
৪৩
|
৭
|
পর্যটকের সাথে বন ভন্তের আলাপ
|
১৩
|
২৯
|
শ্রদ্ধারূপ মূল্য -
|
৪৪
|
৮
|
বন
ভন্তের শাসনপদ্ধতি-
|
১৪
|
৩০
|
সূতার মিস্ত্রীর যন্ত্র-
|
৪৪
|
৯
|
বন ভন্তে কী রাগী? -
|
১৫
|
৩১
|
তাল-মাত্রা-সুর-ছন্দ-
|
৪৫
|
১০
|
বন
ভন্তে কি রাগ মুক্ত?-
|
১৭
|
৩২
|
মারজয় -
|
৪৫
|
১১
|
রসিকতায়
শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তের উপদেশ -
|
১৯
|
৩৩
|
শিক্ষিত-অশিক্ষিত -
|
৪৬
|
১২
|
ত্যাগেই সুখ -
|
২১
|
৩৪
|
নির্বাণ কার জন্য? -
|
৪৬
|
১৩
|
উচ্চ
পদস্থ অফিসারের।
সাথে আলাপ -
|
২৩
|
৩৫
|
বিশ্বাসী কে? -
|
৪৭
|
১৪
|
সঠিক প্রার্থনা -
|
২৫
|
৩৬
|
ইন্দ্রিয় দমন -
|
৪৭
|
১৫
|
জন্ম নিয়ন্ত্রণ -
|
২৬
|
৩৭
|
চিত্ত দমন –
|
৪৮
|
১৬
|
সংগ্রাম -
|
২৭
|
৩৮
|
মদ্যপায়ীর
পঞ্চ অবস্থা-
|
৪৮
|
১৭
|
যথার্থ দর্শন -
|
২৮
|
৩৯
|
বন ভন্তের শর্ত -
|
৪৯
|
১৮
|
কিসে
সুখ কিসেদুঃখ?-
|
২৯
|
৪০
|
কে
পায় কে পায়না?-
|
৫১
|
১৯
|
বন ভন্তে ডি সি? -
|
২৯
|
৪১
|
তাবিজের সন্ধানে -
|
৫২
|
২০
|
বন ভন্তের দৃষ্টি? -
|
৩০
|
৪২
|
দেহ কলসী তুল্য-
|
৫৩
|
২১
|
আগন্তুক ও বন ভন্তে -
|
৩২
|
৪৩
|
বন ভন্তের ভবিষ্যদ্বাণী -
|
৫৪
|
২২
|
সদ্ধর্ম পুকুর -
|
৩৫
|
৪৪
|
ধর্ম বাবা -
|
৫৭
|
২৩
|
নির্বাণ
যাত্রী –
|
৩৬
|
|||
২৪
|
সাধারণ-অসাধারণ-
|
৩৭
|
|||
২৫
|
চিত্তের অনুকূলে দেশনা-
|
৩৮
|
....
বিষয়
|
পৃষ্ঠ
|
বিষয়
|
পৃষ্ঠ
|
||
৪৫
|
বন
ভন্তের সংক্ষিপ্ত
উপদেশ গুচ্ছ -
|
৫৯
|
৫৮
|
ভূতের দুষ্টামি -
|
৮৫
|
৪৬
|
নির্বাণ কোথায়? -
|
৬৩
|
৫৯
|
স্বপ্নে কুকুরে কামড়ায় -
|
৮৬
|
৪৭
|
বন ভন্তে কি অহৎ -
|
৬৬
|
৬০
|
দেবতা-যক্ষ-প্রেত -
|
৮৬
|
৪৮
|
উপযুক্ত পরিবেশ –
|
৬৮
|
৬১
|
অজ্ঞানতার কারণে -
|
৮৭
|
৪৯
|
পঞ্চনিমিত্ত
ও দিক নির্ণয়-
|
৭০
|
৬২
|
যক্ষের ভয় -
|
৮৮
|
৫০
|
অনিচ্ছা সত্বেও অনিয়ম-
|
৭২
|
৬৩
|
দিব্য চোখে দেখে! -
|
৮৯
|
৫১
|
শত্রুর জন্য মঙ্গল কামনা -
|
৭৩
|
৬৪
|
শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তে নিজ
কতটুকু লেখাপড়া করেছেন? -
|
৮৯
|
৫২
|
জ্ঞান চক্ষু -
|
৭৬
|
৬৫
|
ভাল না মন্দ ? -
|
৯০
|
৫৩
|
ওলট পালট-
|
৭৭
|
৬৬
|
ইহকাল-পরকাল -
|
৯১
|
৫৪
|
অপ্রিয়
সত্য -
|
৭৮
|
৬৭
|
সবাই ভাল চায় -
|
৯২
|
৫৫
|
যেখান থেকে এ যাত্রা আবার সেখানে
-
|
৮০
|
৬৮
|
ট্রেক্টর জোগাড় কর -
|
৯৩
|
৫৬
|
খোঁড়ার গিরি লংঘন -
|
৮৩
|
৬৯
|
ধর্মজ্ঞান -
|
৯৪
|
৫৭
|
ভূতের কান্ড -
|
৮৪
|

নমো তস্স ভগবততা
অরহততা সম্মা সম্বুদ্ধ
(সেই ভগবান অরহত
সম্যক সম্বুদ্ধকে নমস্কার)।
সাধক শিবচরণ
ইতিহাসে দেখা যায় যুগে যুগে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন
ধরনের সাধকদের আবির্ভাব ঘটে। তাদের ধ্যান ধারণা, মত ও পথ বিভিন্ন ধরণের পরিলক্ষিত
হয়। বিশেষ করে বৃহত্তর পার্বত্য জেলায় তিন জন সাধকের কীর্তি এবং ধ্যান ধারণা
সম্বন্ধে জানা যায়।
প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে শিবচরণ নামে এক সাধক এই পার্বত্য জেলায়
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কীর্তিকলাপ সাধনা সম্বন্ধীয় নানা উপখ্যান, পুথি ও পালা গান
চাকমা ভাষায় দেখা যায়। তাঁর জীবনীর উপর ভিত্তি করে রচিত নানা ধরণের গান পার্বত্য
জেলার জনসাধারণের আনন্দ বৰ্দ্ধন ও ঐতিহ্য সংরক্ষিত করেছে। কথিত আছে শিবচরণ এক
স্থান হতে অন্য স্থানে অলৌকিক ভাবে চলে যেতেন। তাঁর মায়ের দেওয়া পাতায় পুটুলি
বাধা ভাত এক স্থানে রেখে দিয়ে ১২ বৎসর পর গরম গরম অবস্থায় আহার করেছিলেন।
বর্ষার ঢলের সময় ছোট খালের বা ছড়ার উপর একটা বাঁশ রেখে ছড়ার
পানি বন্ধ করতেন। বাশের সমান উচু বাঁধ তৈরী হলে এ বাঁধের নীচ দিয়ে শুকনা অবস্থায়
লোকজন পারাপার হতো। আরো দেখা যায় কারো অসুখ হলে পানি পড়া অথবা সামান্য শিকড়
দিলে রোগ নিরাময় হতো। মধ্যে মধ্যে তিনি দেশবাসীর প্রতি সৎ উপদেশ দিয়ে মহা উপকার
সাধন করতেন। জনশ্রুতিতে জানা যায় সাধক শিবচরণ স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুবরণ না করে
অলৌকিক ভাবে অন্তর্ধান হয়ে যান। মৃত্যুকালে তিনি বলে গেছেনযেদিন পার্বত্য অঞ্চল
ধনে-ধান্যে পরিপূর্ণ হবে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নত হবে, সেদিন তিনি উচ্চকুলে জন্ম
গ্রহণ করবেন।
সাধক যম
রাঙ্গামাটি
হতে প্রায় ১৪ মাইল উত্তর পূর্বদিকে ঘন গাছ বাঁশে পরিপূর্ণ সর্বোচ্চ যম পাহাড় অবস্থিত।
যম পাহাড় এমন জায়গায় অবস্থিত যার চার পাশে চারটি ইউনিয়ন। আবার থানা হিসাবে ভাগ করেছে
তিন দিকে তিনটি থানা।উত্তর পূর্বকোণে লংগদু থানা, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে রাঙ্গামাটি
সদর ও উত্তর পশ্চিম কোণে নানিয়ার চর থানা অবস্থিত। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় সর্বোচ্চ
পাহাড়ের চুড়ায় মধ্যে দেখা যায় প্রথমে সাপছড়ি পাহাড়ের চুড়া, উত্তরে বরকল পাহাড়ের চুড়া
এবং মধ্যখানে যম পাহাড়ের চুড়া বা যমচুগ। যমচুগে উঠলে দেখা যায় দক্ষিণে কাপ্তাই পর্য্ন্ত
এবং উত্তরে বরকলের ভারত সীমান্ত পর্য্ন্ত।
যম পাহাড়টি মনুষ্য
বসতিহীন ভাবে পড়ে আছে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর যাবৎ। তন্ত্র-মন্ত্র ধারী জটাচুল বিশিষ্ট
যম নামে এক চাকমা সাধক তাঁর পরিবার নিয়ে এই পাহাড়ে বসবাস করতেন। তাঁর আসল নাম ইমিলিক্যা
চাকমা। তন্ত্র-মন্ত্র শক্তি বলে হিংস্র প্রাণীরা তাঁর পরিবার এবং গরু মহিষের ক্ষতি
করতনা। কথিত আছে গরু মহিষ বাঘের সাথে চড়ত। সেই পাহাড়ের চুড়ায় বা চুগে আগুন জ্বালিয়ে
যম তপস্যা করতেন। এ ভাবে অনেক বছর অতিবাহিত করার পর পরিণত বয়সে যম মারা যান। মারা যাওয়ার
পূর্বে এক ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, এই পাহাড় একদিন তীর্থস্থানে পরিণত হবে। সেই সময়
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে শ্রমণ অবস্থায় কাপ্তাই এর কাছে ধনপাতায় গভীর বনে ধ্যান সমাধি করতেছিলেন।
ভন্তের নাম উল্লেখ করে বলেছেন ধনপাতার শ্রমণই একদিন এখানে আসবেন।
যম মারা যাওয়ার
পর তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সেই পাহাড় ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। বর্তমানে যমের নাতি জগৎ
কিশোর চাকমা এক গ্রামে বাস করে। তার বয়স প্রায় ৫০ বছর। সে ভাল বাঁশী বাজাতে জানে। যমের
ভাগিনী জামাই চাকমা ভাষায় যমরে পঁথি আবৃত্তি করে সকলের আনন্দ প্রদান করে।
স্থানীয় লোকজন
রাঙ্গামাটি বন বিহারে আসলে সব সময় যমের ভবিষ্যত বাণীর কথা বন ভন্তের নিকট স্বরণ করায়ে
দেয় এবং অনুরোধ করে ‘‘
আপনি অনুগ্রহ পূর্বক
আমাদের যম পাহাড়ে একখানা বিহার স্থাপন করুন’’। বহুবার অনুরোধ করার পর শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে বিহার নির্ষ্মানের
সম্মতি দেন।
যম
পাহাড়ের চারিদিকে বসতিগুলি প্রায় দুই মাইল দূরে অবস্থিত। চার ইউনিয়নের সমন্বয়ে অধিবাসীরা
কঠোর পরিশ্রম করে দক্ষিণে মাইশ্যা পাড়া হতে যম পাহাড় পর্য্ন্ত প্রায় চার মাইল দীর্ঘ
এক বনপথ নির্ষ্মাণ করে। যমচুগে যমের লাগানো এক অশ্বথ বৃক্ষের পাশে বন বিহার প্রতিষ্ঠিত
হয়। বন বিহারের দক্ষিণ পার্শ্বে ভান্ডার ঘর স্থাপন করা হয়। যমচুগের পূর্বদিক একটু নীচে
মধ্য পাহাড়ে যাত্রীদের থাকার এক অতিথিশালা নির্ষ্মিত হয়। পূর্ব দিকে নীচের পাহাড়ের
প্রায় সমান জায়গায় মেলা বসানোর জন্য ছোট ছোট ঘর এবং কঠিন চীবর তৈয়ার করার জন্য প্রায়
দুইশত হাতের বিরাট শনের ঘর তৈয়ার করা হয়।
যমচুগ বন বিহার
উদ্বোধন করবেন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে। জ্যৈষ্ঠ মাসের একদিন সকালে ছোট লঞ্চে করে সশিষ্য
বন ভন্তে প্রায় দুই ঘন্টায় মাইশ্যা পাড়া বিহারে পৌছেন। তাঁর সঙ্গে আমরা দায়ক ছিলাম
বিশজনের মত। সেখানে দুপুরের ভোজন করার পর বিকাল ২ ঘটিকায় আমরা যমচুগের উদ্দেশ্যে যাত্রা
করি।স্থানীয় শ্রদ্ধাবান দায়ক শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে দোলায় করে জয়ধ্বনি দিতে দিতে যমচুগে
নিয়ে যায়। আমরা চার মাইল পথ কয়েকটা পাহাড় অতিক্রম করে সন্ধ্যা ছয়টায় যমচুগে পৌছি।
চট্টগ্রাম কোর্ট
বিল্ডিং উঠলে চট্টগ্রাম শহর এবং বঙ্গোপসাগরের যে রকম সুদৃশ্য দেখা যায় সে রকম যমচুগে
উঠে চারি পার্শ্বের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে সত্যই বিমোহিত হই। গ্রামগুলি দুই তিন মাইল
দূরে হলেও মনে হয় অতি সন্নিকটে অবস্থিত। যমচুগের উত্তরে ও দক্ষিণে ধাপে ধাপে সাজানো
পাহাড় অতি মনোরম লাগে। পশ্চিম ও পূর্ব দিকে জলাশয়ে ছোট বড় বহু নৌযান এবং ঝাঁকে ঝাঁকে
পাখীর আনাগোনা খুবই মনোমুগ্ধকর। রাতে রাঙ্গামাটি এবং কাপ্তাই এর বিদ্যুৎ বাতিগুলি হ্রদের
জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে আকাশের তারার মত চমৎকার দেখায়। এ রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিশোভিত
নির্জন যমচুগে যে কোন ভাবুক ব্যক্তি বা সাধকের পক্ষে ভাবনার অতীব উপযোগী স্থান হিসাবে
অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। যেমন মনে হয় কোন এক সুদক্ষ চিত্র শিল্পীর মনোময় তুলির আঁচড়ে
আঁকা এক বৈচিত্রময় পূর্ণ এক চিত্র।আরো স্বরণ করায়ে দেয় ত্রিপিটকের বর্ণিত গোশৃঙ্গ পর্বতের
মনোরম দৃশ্যের এবং ভগবান বুদ্ধের দেশনার কথা।
সন্ধ্যার সময়
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে প্রথমে আমাদের প্রতি লক্ষ্য করে ধর্ম দেশনায় বলেন- আজ তোমরা মাইশ্যা
পাড়া হতে যে পথ দিয়ে অতিকষ্টে কয়েকটা পাহাড় অতিক্রম করে যমচুগে পৌছেছ। যম চুগে উঠে
খালি চোখে চারিদিকে সুষ্পষ্ট ভাবে যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছ তাতে সত্যই তোমাদের বিপুল আনন্দ
উপভোগ হচ্ছে। যারা সমর্থবান অর্থাৎ স্বীয় চেষ্টার ফলে মাইশ্যা পাড়া হতে যমচুগে পৌছেছে।
আর যারা শিশু, বৃদ্ধ ও দুর্বলা নারী তারা যমচুগে উঠতে পারে নাই ঠিক সেই রকম যারা দুর্বল,
উদ্যম হীন ও শীল সমাধি প্রজ্ঞাহীন তারা নির্বাণ লাভ করতে সমর্থ হবেনা। নির্বাণ লাভ
করা, প্রত্যক্ষ করা অতি কঠিন ব্যাপার, কিন্তু দুর্লব নয়। নির্বাণ লাভ করতে পারলে যমচুগের
মত স্বত্বগণের সুখ -দুঃখ, হীন -উত্তম,স্বর্গ - নরক, দেবলোক, ব্রক্ষলোক, এমনকি একত্রিশ
লোক ভূমি সম্বন্ধে জ্ঞান দ্বারা অবগত হওয়া যায়। ভগবান সম্যক সমুদ্ধ নির্বাণ গমনের রাস্তা
বা আর্য্ অষ্টাঙ্গিক মার্গ আবিস্কার বা নির্মাণ করেছেন। সেই পথ অনুসরণ করেই নির্বাণ
লাভ করা যায়। নির্বাণ লাভ করতে হলে প্রথমে শীলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পঞ্চ পাহাড় অতিক্রম
করে প্রজ্ঞারুপ অস্ত্র দ্বারা সপ্ত অনুশয় বা ক্লেশ শত্রুকে পরাজয় করে সর্বদুঃখ মুক্ত
নির্বাণ লাভ করা যায়।নির্বাণ লাভের পথ সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক
কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্সৃতি ও সম্যক সমাধি এই আটটির সমন্বয়ে
নির্বাণ লাভ করা যায়।যাঁরা আর্য্ তাঁরা এই বুদ্ধ নির্দেশিত পথে অগ্রসর হয়ে নির্বাণ
লাভ করতে পারেন।’’
বন ভন্তে যমচুগ উপমা
নির্বাণ দেশনা শুনে আমাদের যাবতীয় শারীরিক পরিশ্রম, ক্লান্তি আপাততঃ দূরীভূত হয় এবং
সংগে সংগে এক অপূর্ব প্রীতি অনুভব করলাম।
কমিটির আতিথেয়তায়
অতিথিশালায় রাত্রি যাপনের পর সকালে আমাদের পাশেই জাগরিত ব্যক্তিরা অমনুষ্যের এক বিরাট
শব্দ শুনতে পান। আমরা আগে থেকেই শুনেছি এখানে হিংস্র প্রাণী, ভূত, প্রেত ও যক্ষের উপদ্রব
আছে। আরও জানলাম ভান্ডার ঘরের দরজার সামনে কয়েকটি বাঘ এসেছিল। সেইদিন সকাল থেকে গুড়ি
গুড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। মনে মনে চিন্তা করলাম বাহিরের লোক বৃষ্টিরজন্য আসতে পারবেনা।
দেখা গেল দশটার সময় আকাশ প্রায় পরিস্কারহওয়ায় দশটা তিরিশ মিনিটে বুদ্ধ পূজা সংঘদান
ও বিহার উৎসর্গ সম্পন্ন হয়। দুপুরের ধর্ম সভায় বিপুল সংখ্যক লোক অংশ গ্রহন করে। দায়কদের
প্রার্থনায় বন ভন্তে সেই রাতে নানাবিধ উপদ্রব বন্ধ হওয়ার জন্য সূত্র পাঠ করেন। তৃতীয়
দিন সকালেও ধর্ম সভা হয়। দুপুরের ভোজনের পর বন ভন্তে দোলায় করে মাইশ্যা পাড়া বিহার
ঘাটে আসেন। সেখান থেকে আমরা লঞ্চযোগে রাত আটটায় রাঙ্গামাটি বন বিহারে পৌছি।
যমচুগে কঠিন
চীবর দান অথবা বিশেষ কোন ধর্ম অনুষ্ঠানে বন ভন্তে পর্দাপণ করেন। সেখানে বনভন্তের প্রধান
শিষ্য শ্রীমৎ নন্দপাল স্থবিরসহ আরো চারজন ভিক্ষু এবং তিনজন শ্রমণ ধ্যান
সমাধিতে রত থাকেন। স্থানীয় দায়কবৃন্দ পালাক্রমে খাদ্যে ও জলের ব্যবস্থা করেন।
বন
ভন্তে প্রশস্তি
নমি আমি বন
ভন্তে ; নমি শ্রীচরণে।
তমঃ তৃষ্ণা
ক্ষয় হোক তোমায় স্মরণে।।
দুরে থাক কাছে
থাক সর্বদাই স্মরি।
ভব সাগর পার
হব তব শিক্ষা ধরি।।
করুণার নিধি
তুমি মুক্তি প্রদর্শক।
অন্ধকারে আলো
তুমি সদ্ধর্ম ধারক।।
তোমার পরশ
পেয়ে দেব নরগণে।
চিত্তমল দূর
করে আনন্দিত মনে।।
|
অবিদ্যার বিকর্ষণে জ্ঞানলোকে থাকি।
চারি আসব নাশে হয়েছ চির সুখী ।।
ধর্ম পিপাসুর প্রাণে দিয়ে ধর্ম তত্ব।
নির্বাণ বারিতে সবে হোক শান্ত চিত্ত।।
তব আয়ু দীর্ঘ হোক জীবের হিতার্থে।
দিবানিশি স্মরি আমি দুঃখ বিনাশীতে।।
যে সম্পদ পেয়ে তুমি আছ তৃপ্ত মনে।
অকাতরে দিতে থাক তব ভক্ত গণে।।
|
মহান সাধক বন
ভন্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী
বৃহত্তর পার্বত্য জেলা তথা
বাংলার ভাগ্যাকাশে উদিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ভিক্ষুকুল গৌরব, বৌদ্ধ ধর্মের
ধ্বজাধারী, মহান ত্যাগী, পঞ্চমার বিজয়ী এবং দেব মনুষ্যের পূজনীয়, শ্রদ্ধেয়
শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বন ভন্তে) মহোদয় কাপ্তাই এর সন্নিকটে মগবান মৌজার মোরঘোণায়
১৯২২ খৃস্টাব্দে মর্তধামে আবির্ভূত হন। তার -পিতার নাম হারুমোহন চাকমা এবং মাতার
নাম বীরপতি চাকমা। তার পিতা মাতা উভয়ে ছিলেন সেই যুগের শীলবান ও ধর্মপ্রাণ
দম্পতি। শ্রদ্ধেয় ভন্তের গহীনাম ছিল রথীন্দ্র চাকমা।
শিশু রথীন্দ্র যখন পাঁচ বৎসরে পদার্পণ করলেন,
তখন উপবেশনে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় এক উজ্জ্বল আলোর দৃশ্য দেখে বিমোহিত হতেন।
প্রথমে তিনি ভয়ার্ত হয়ে চিন্তা করতেন। পরিশেষে তিনি নিজে নিজেই বুঝতে পারলেন যে,
ইহা একটি আলোক নিমিত্ত মাত্র !,
অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলাধূলার সময়
অতিবাহিত করতেন না, বরঞ্চ ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন নিমিত্ত দেখে নীরবে বসে চিন্তায়
মগ্ন থাকতেন। মধ্যে মধ্যে ছোট নদী বা খালের কূলে পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় অথবা বৃহৎ
গাছের মূলে নানা প্রকার পশু বলির বা পূজার দৃশ্য দেখে হতভম্ব হতেন এবং বিয়ে
(চুবলং) এর সময় মুরগী বলি দিয়ে সেই মুরগীর পা ও ঠোট পূজায় উপস্থাপন করা হলে
ছেলে মেয়েরা খুব খুশী ও আনন্দিত হতো কিন্তু তিনি বিষাদ চিত্তে চিন্তা করতেন।
কেননা বিয়ের পরে দম্পতি কিছু সময়কাল বেশ হাসি ও আনন্দোল্লাসের মধ্যে দিয়ে
অতিবাহিত করার পর পরেইদেখা যায় প্রায় অনেকেই নানাবিধ পারিবারিক কারণে কলহ এবং
মারামারি করত। মানুষের এসব দুঃখ তিনি গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করতেন।
তদানিন্তন বৃটিশ আমলে তিনি নিম্ন মাধ্যমিক
বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শিখে ছিলেন। তিনি উক্ত লেখা পড়ার
দ্বারা বাঙলা ভাষায় যে কোন বই অনায়াসে পড়তে পারতেন এবং সহজেই আয়ত্ব করতে
পারতেন। তাই গৃহী অবস্থায় তিনি বহু ধর্মগ্রন্থ এমনকি রামায়ণ, মহাভারতও অধ্যয়ন
করেছেন।
একদিন এক নামধারী মাত্র বৈষ্ণব সাধু গান গেয়ে
শুনালেন “হরির
নাম যার মুখে নেই, তার মুখ পানে চেয়োনা।” তা শুনে তিনি মনে মনে ভাবলেন-এই সাধু আমাদেরকে ঘৃণা
করে। কারণ আমরা তো হরির নাম লই না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন-তা’ ঐ নামধারী সাধুর অজ্ঞানতা।
তিনি বৌদ্ধ ধর্মীয় পুস্তক সংগ্রহ করে মনোযোগের
সাথে অধ্যয়ন করতেন। তা ছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কামিনী রায় এবং
অন্যান্য বিখ্যাত কবিদের কবিতাও পড়েছিলেন। তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল, তাই
তাদের কবিতাগুলো। এখনো অনর্গল মুখস্থ বলতে পারেন। তিনি পৃথিবীর বড় বড় বৈজ্ঞানিক,
দার্শনিক, পন্ডিত, কবি ও সাহিত্যিকের জীবনী পুনঃ পুনঃ পড়তে ভাল বাসতেন।
প্রবীণ ব্যক্তির মুখে শুনেছি তিনি যখন গৃহস্থালীর কাজ করতেন সেই
সময় মাঝে মাঝে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন এবং অনেক সময় কাজের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে
যেতেন। গৃহীকালে তিনি খুব সরল, ধর্মপ্রাণ, ভাবুক এবং সর্ববিষয়ে অনাসক্ত ছিলেন,
তাই কোন জিনিসের প্রতি তাঁর লোভ ছিলনা।
আরো উল্লেখ্য যে, রথীন্দ্রের বয়স যখন ছাব্বিশ বৎসর তখন তিনি
একখানা ছোট নৌকা নিয়ে নদীর কূলের পাশে পাশে স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছিলেন, এমন
মুহুর্তে এক বৃদ্ধ লোক নদীর অপর পাড়ে পাড় করে দেয়ার জন্য তাকে ডাকলেন। জ্ঞাতব্য
যে লোকটি সকলের সাথে হাসি ঠাট্টা এবং ব্যঙ্গ কথা উচ্চারণ করে বলে কেহ বিশ্বাস
করতনা তাই তিনি লোকটার ডাক শুনেও না শুনার মত রইলেন। পরে চিন্তা করলেন ঐ ব্যক্তিকে
নদী পার করে দিলে আমার অশেষ পূণ্য সঞ্চয় হবে। তা ভেবে নৌকাতে তাকে তুলে নিলেন। লোকটি
নৌকাতে উঠার পর বললেন-“আমাকে
অমুক জায়গায় নিয়ে যাও।”
তিনি তার প্রত্যুত্তরে বললেন- এই মাত্র আমাকে বললেন নদী পার করানোর জন্য, আবার এই
মুহুর্তে বলছেন অমুখ জায়গায় দিয়ে আস। এটা কেমন কথা? লোকটি হেসে বলল -তুমি তো
প্রথম ডাকে আস নাই তাই ওখানে যাওয়ার কথা বলে তুমি কখনো আসতেনা। এই কথা শুনে
রথীন্দ্র একটু মৃদু হেসে-তাকে নিয়ে নদীর উজানে নৌকা চালাতে লাগলেন। নৌকার
দুপ্রান্তে দু’জন
সামনাসামনি বসে তিনি নৌকা চালাতে লাগলেন। নদীর এক বাক যাওয়ার পর সেই ব্যক্তি
রথীন্দ্রকে ক্ষীণ স্বরে, চোখের ইশারা ও ভঙ্গিমায় সুন্দরী রমনী দেখার জন্য বার বার
ইঙ্গিত দিতে লাগল। তিনি তার দিকে দৃষ্টি না যায় মতো নৌকা চালাতে লাগলেন। একটু পর
ঐব্যক্তিকে দেখলেন যে, অপলক নেত্রে সুন্দরী রমনীর দিকে তাকিয়ে আছে।
এ সব কথা উল্লেখ করতে গিয়ে এক সময় বন ভন্তে
উদাহরণ স্বরূপ বললেন- ঐ ব্যক্তি যেমনি ভাবে রমনীর দিকে তাকায়ে ছিল ঠিক তেমনি ভাবে
শিয়ালেরাও মহিষের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভন্তে কথা বলতে না বলতে উপাসক-উপাসিকাদের
মধ্যে হাসির সোরগোল পড়ে গেল। তখন ভন্তে বলেন-আচ্ছা তোমরা বল, শিয়াল মহিষ ধরতে
পারে কিনা? আমরা বললাম-না ভন্তে। তা হলে ঐ ব্যক্তিও অপলক নেত্রে রমনীর দিকে
তাকিয়ে ছিল কেন? আমরা বললাম সেটা দুষ্টামি মাত্র। উনি বললেন- এটা হল কামাসক্তি।
এতে চিত্ত কলুষিত হয়। চিত্ত অস্থির হয় এবং কামাসক্তিতে চিত্তের বিকার প্রাপ্তি
ঘটে। এতে বুঝা যায় যে তিনি যৌবন কালেও অত্যাধিক সরল ও সাধু জীবন যাপন করেছিলেন।
" ছোট বেলা থেকে তিনি বুদ্ধ কীর্তন, কবিগান ও যাত্রাগান আগ্রহের সাথে শুনতেন।
ঐসব শুনে তিনি গভীর ভাবে উপলব্ধি এবং চিন্তা করতেন- এই সংসারটাই যাত্রার মঞ্চ। কত
সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না ইত্যাদি নানাবিধ সংঘাতের ভিতর দিয়ে চলতে হয়। সংসারটাই যে
দুঃখময় তা তিনি সব সময় নিরীক্ষণ করতেন। তাই সংসারের দোষ ছাড়া গুণ কিছুই দেখতেন
না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আরো লক্ষ্য করলেন-এক
সময় জনৈক ব্যক্তির এগার বৎসরের এক মাত্র কন্যা মৃত্যু বরণ করেছে। সবাই দলে দলে
সেখানে উপস্থিত হচ্ছে দেখে তিনিও ঐ মৃত কন্যার পিতার বাড়ীতে উপস্থিত হন। সেখানে
উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন মৃত কন্যাকে বারান্দার এক পাশে শায়িত অবস্থায় রাখা
হয়েছে। অন্যদিকে পিতা মাতা কখনো উচ্চস্বরে কেদে উঠছে, কখনো বুকে হাত দিয়ে আঘাত
করছে,কখনো গাছের সাথে মাথাকে সজোরে আঘাত করছে, কখনানো অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে
রয়েছে। আর উপস্থিত লোকজন মৃত কন্যার পিতা মাতাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বিভিন্ন
উপদেশ দিয়ে বুঝাচ্ছে ও সেবা যত্ন করছে। যুবক রথীন্দ্র ঐ সময় চিন্তা করলেন আমারও
একদিন এই ভাবে মৃত পুত্র কন্যার জন্য কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হতে হবে। তিনি সেখাইে মনে
মনে দৃঢ় সংকল্প করলেন যে, তিনি আর সংসার বন্ধনে আবদ্ধ
হবেন
না। তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ যেমন জরা, ব্যাধি, মৃত ব্যক্তি ও সন্ন্যাসী এ চতুর্বিধ
দৃশ্য দেখে গৃহ ত্যাগ করেছিলেন, ঠিক তেমনি বন ভন্তেও অপরের এক মাত্র মৃতকন্যা দেখে
গৃহত্যাগ করার সংকল্পবদ্ধ হন।
গৃহ ত্যাগ করার সংকল্প নিয়ে প্রব্রজ্যা
গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় গেলেন, পরবর্তীতে পটিয়া নিবাসী এক প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবু গজেন্দ্র লাল বড়ুয়ার সহায়তায় ১৯৪৯ ইংরেজীতে চট্টগ্রাম
বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ দীপংকর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের নিকট তিনি প্রব্রজ্যা
লাভ করেন। দীপংকর ভন্তে ছিলেন সে যুগের প্রথম বি.এ পাশ ভিক্ষু এবং ত্রিপিটক
বিশারদ। বন ভন্তে ১৯৪৯ ইংরেজী থেকে ১৯৫২ ইংরেজীর কিছু সময় পর্যন্ত সেখানে ছিলেন
এবং সেই বিহারে থাকালীন তাঁর গুরুরনিকট যেসব বাঙলা ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ
ছিল তা সব আগ্রহের সাথে অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি চিন্তা করলেন-শুধু ত্রিপিটক
অধ্যয়ন করলে লোকোত্তর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়না। তাঁকে মুক্তির পথ নিশ্চয়
খুঁজতে হবে। তিনি মনে মনে চিন্তা করতেন মস্তক মুন্ডন করে কাষায় বস্ত্র পরিধান
করার মূল্যই বা কি? গুরুর নিকট তিন বৎসর যাবৎ শ্রমণ ধর্ম শিক্ষা করে গুরু ভন্তেকে
জিজ্ঞাসা করলেন-লোকোত্তর ধর্ম কি রকম?” ভন্তে উত্তরে বললেন-“আমি নির্বাণ দর্শন করি
নাই, আমার লোকোত্তর জ্ঞান নাই সুতরাং তুমি যেখান থেকে এসেছ সেখানে নির্বাণ গবেষণা
করে লোকোত্তর জ্ঞানের অধিকারী হও।’’
১৯৫২ ইংরেজীতে গুরু ভন্তের নির্দেশ মতে তিনি
কাপ্তাই এর পাশে ধন পতায় চলে আসেন। প্রথমে তিনি চিন্তা করলেন গুরু ছাড়া কিভাবে
তিনি ভাবনা করবেন। তাঁর উদ্দেশ্যই বা কি? মরণ পণ উদ্যম নিয়ে যেমন বৈজ্ঞানিক নিউটন
আবিস্কার করেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ আবিস্কার করেন নির্বাণ,
ঠিক তেমনি ভাবে মরণ পণ উদ্যম নিয়ে তিনিও তথাগতের ন্যায় নির্বাণ সাক্ষাৎ করার
দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞান গবেষণা করতে করতে যেমন
ঘুম যাননি, তিনিও নির্বাণ গবেষণা করতে করতে ঘুমাতেন না। মহাত্মা গান্ধী যেমন অল্পহার
ও শীতোষ্ণ সহ্য করতেন ঠিক তেমনি তিনিও তাই করতেন। ডুবরী নিজের জীবন উপেক্ষা করে
সমুদ্রের তলদেশ হতে মণি মুক্তা আহরণ করে, সেরূপ তিনিও গভীর বনে (ধনপাতায়)
চারিমার্গ, চারিফল ও নির্বাণ অর্থাৎ লোকোত্তর ধর্ম আহরণ করবেন। যুদ্ধে সৈনিকেরা
যেমন পিছু না হটে সামনের দিকে শত্রুদের সাথে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে জয়ী হয়,
তেমনি তিনিও ক্লেশমার, দেবপুত্র মার, অভিসংস্কার মার এবং স্কন্ধ মারের সাথে যুদ্ধ
করবেন। এই পঞ্চমার জয় করতে পারলেই নির্বাণ অধিগত হবে। তিনি পাঁচটি ব্রত গ্রহণ করে
কঠোর সংযমের মাধ্যমে ধ্যানে মনোনিবেশ করলেন।
গ্রাম হতে অনেক দুরে ধ্যান স্থানে (ধনপাতায়)
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে, নানাবিধ পোকার উপদ্রব, গ্রীস্মকালে প্রখর রৌদ্র এবং
শীতকালে অসহ্য শীত সহ্য করতেন। অনেক সময় আলস্য বা ঘুম আসলে গ্রীস্মকালে শনবনে
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে এবং শীতকালে ঝর্ণা বা খালের পানিতে নেমে বলতেন-“ঘুম এইবার তুমি
আস।” এ ভাবে ব্রতচ্যুত না হয়ে ১৯৬০ ইংরেজীর মাঝামাঝি পর্যন্ত কঠোর ধ্যান সমাধিতে
মগ্ন, ছিলেন। তিনি কয়েক দিনে একবার মাত্র আহার করতেন। অনেক সময় গ্রামে ভিক্ষা।
করতে দেবী হলে আহার ফেলে জলপান করতেন। তাঁকে গ্রামবাসীরা রথীন্দ্ৰ শ্ৰমণ হিসাবে ডাকতো
এবং গভীর বনে সাধনা করেন বলে তিনি বন সাধক হিসাবে অন্যত্র পরিচিতি লাভ করেন।
গভীর বনে ধ্যান অবস্থায় শ্রমণের পরনে এক পোশাক
মাত্র চীবর ছিল, তাও অধিক পুরাতন হওয়ায় একবার তার চীবর ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম
হয়েছিল। বিনয়ে উল্লেখ আছে যে কারো নিকট হতে চেয়ে দান গ্রহণ করতে নেই এ বলে তিনি
কারো কাছ থেকে চীবর চেয়ে নেননি। ফলে উক্ত ছেড়া চীবর দ্বারা তাঁর নড়াচড়া করতে
নানা অন্তরায় বা অসুবিধা হয়েছিল। এ সব অসুবিধা ভেবে তিনি তার জমাকৃত একখানা সাদা
বস্তু চীবর হিসাবে সেলাই করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু পরক্ষণে হঠাৎ তার মনে বোধদয় বা
জ্ঞানোদয় হলো সাদা চীবর সেলাই করে পরিধান করার বিধান নেই। তাই তিনি তা না করে
একাগ্র চিত্তে ধ্যানবস্থায় দিন যাপন করতে লাগলেন। দুয়েক দিন পরে দেখলেন কয়েক জন
বড়ুয়া উপাসক দল বেঁধে কযেক খানা চীবর নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। সত্যিই তারা ঐ
সময় ভন্তেকে চীবর দান করে পূণ্যের অধিকারী হয়েছিলেন। বড়ুয়া সেজে ঐ সময়
দেবতারাই আগমন করেছেন বলে আমার ধারণা।
আরো উল্লেখ করা যেতে পারে শ্রদ্ধেয় ভন্তে
(শ্রমণ) যেই বনে ধ্যান সমাধিতে মগ্ন ছিলেন, সেই বনে (ধনপাতায়)) নানা প্রকার
হিংস্র জন্তুর উপদ্রব ছিল। এক বাঘ একটা মহিষ মেরে তার সামনে আহার করতে ছিল কিন্তু
ভন্তের পূর্ব জন্মের পূণ্যকৃত সঞ্চিত পারমী এবং ইহ জন্মের সত্য এবং জ্ঞানের
প্রভাবের দ্বারা ধ্যানে কোন হিংস্র জন্তুর উপদ্রব হয়নি। অর্থাৎ তিনি অপ্রমত্ত
হয়ে নির্বাণ সাক্ষাৎ করার প্রত্যাশায় ধ্যান সমাধিতে মগ্ন ছিলেন বলে কোন অন্তরায়ও
সৃষ্টি হয়নি।
তবে কাপ্তাই হ্রদের জলে তার বনাশ্রম নিমজ্জিত
হয়ে যাওয়ার ফলে ১৯৬০ ইংরেজী ধনপাতা নিবাসী দিঘীনালায় অবস্থানরত ধর্মপ্রাণ দায়ক
বাবু নিশিমনি চাকমার প্রার্থনায় শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে দিঘীনালায় চলে যান।
দিঘীনালার জনগণ তাঁর জন্য লোকালয় হতে একটু দূরে এক বন বিহার স্থাপন করে
দিয়েছিলেন। তথায় শ্রমণ অবস্থায়। কিছুকাল ধ্যান করার পর ১৯৬১ ইংরেজী শ্রীমৎ
জিনবংশ মহাস্থবির, শ্রীমৎ আনন্দমিত্র মহাস্থবির, শ্রীমৎ গুণালংকার মহাস্থবির,
শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির সহ অনেক পন্ডিত ভিক্ষুর
উপস্থিতিতে তিনি উপসম্পদা লাভ করেছিলেন।
ধনপাতা ও দিঘীনালায় থাকাকালীন তিনি দেশনার
সময় অথবা অন্য সময় কথা বলার সময় আমি আমার বলতেন না। কারণ আমি অর্থ মান ধ্বংস
করা এবং আমার অর্থ তৃষ্ণা ধ্বংস করা অভ্যাস করতেন। আমি আমার পরিবর্তে তিনি শ্রমণ
অথবা শ্রমণের বলতেন।
ভিক্ষু জীবনে তিনি ধ্যান সমাধির কঠোরতা থেকে
ভগবান বুদ্ধের উপদেশানুযায়ী মধ্যপথ অবলম্বন করেন। তাই তার উপমার মাধ্যমে বুঝা
যায় যে, কোন লোক পথ হারিয়ে বন জঙ্গল, কাঁটাবন, উঁচু, নীচু, ঝর্ণা, পাহাড়ের
খাড়া জায়গা অতিক্রম করে হঠাৎ রাস্তার সন্ধান পেলে লোকটি সে রাস্তা দিয়ে গন্তব্য
স্থানে যেতে পারে তেমনি তিনিও গুরু ছাড়া বহু শ্রমের মাধ্যমে শমথ ধ্যান করে পরে
বিদর্শনে উপনীত হন। আর বিদর্শন ভাবনার দ্বারা যাবতীয় মার জয়, অবিদ্যা, তৃষ্ণা,
মান ইত্যাদি ত্যাগ করে নির্বাণ সুখ প্রত্যক্ষ করেন।
শ্রদ্ধেয় বনভন্তে ১৯৭০ ইংরেজীতে দিঘীনালা
হতে দূরছড়িতে চলে আসেন। সেখানে ছয় সাত মাস থাকার পর লংগদুর বিশিষ্ট ধনাঢ্য ও
ধর্মপ্রাণ বাবু অনিল বিহারী চাকমা (হেডম্যান) এর প্রার্থনায় তিনটিলায় ঐ সালেই
চলে আসেন।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের দেশনায় জানা যায় যে
১৯৭১ সালে তিনিটিলায় থাকাকালীন তার অভিষ্ঠ লক্ষ্য ও ধ্যানের পূর্ণতার বিকাশ ঘটে।
তাঁর লোকোত্তর দেশনায় বহু নরনারী (যারা ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিশ্বাসী) প্রীতি
সুখানুভব করেন।
১৯৭৪ ইংরেজীতে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের
শ্রদ্ধাশীলা মাতা আরতি রায় ও রাঙ্গামাটির বিশিষ্ট উপাসকের আকুল আবেদনে রাজবন
বিহারে অবস্থান করার সম্মত হন। তাই ১৯৭৬ ইংরেজীতে তিনটিলা থেকে সশিষ্যে রাঙ্গামাটি
রাজবন বিহারে শুভাগমন করেন। তাঁর এ আগমনের ফলে বহু আবাল বৃদ্ধ বণিতার বহু পূণ্য
চেতনার জোয়ার আসে। প্রায় দিনেই পুণ্য সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়ে অনেকেই লোকোত্তর
জ্ঞান লাভেরও সক্ষম হচ্ছেন বলে আমার বিশ্বাস। ১৯৮১ ইংরেজীর ১৪ই ফেব্রুয়ারী তাঁকে।
মহাস্থবির পদে বরণ করা হয়।
(মহান সাধক বন ভন্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী সমাপ্ত)

নির্বাণ গমনের চাবিকাঠি
শ্রদ্ধেয় বনভন্তের দেশনায়
বলেছেন- নিজের কর্ম প্রচেষ্টা দ্বারা চারি আর্য সত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, পটিচ্চ
সমুল্লাদ এবং সাইত্রিশ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্ম আয়ত্ব করা যায়। যা আমি প্রকাশ
করি তা আমার অভিজ্ঞতার দ্বারা ব্যক্ত করি। যা দৃষ্ট ও শ্রুত তা’ সম্যক জ্ঞানের দ্বারা
উপলব্ধি করি। আমি আমার জন্ম জন্মান্তরের অনুগমনকারী। অবিদ্যা ও তৃষ্ণাকে ক্ষয়
করেছি এবং অঙ্গ জীবনও ত্যাগ করে পরম সুখ অনুভব করছি। গভীর শ্রদ্ধা, স্মৃতি,
একাগ্রতা, প্রজ্ঞা,ইন্দ্রিয় সংযম ও চিত্ত সংযমই নির্বাণ গমনের একমাত্র চাবিকাঠি।
তিনি বলেন-আমি যে ভাবে কঠোর হতে কঠোরতম ভাবনা করেছি তা আমার নির্দেশ অনুসরণকারী
অনায়াসে সর্বদুঃখের অন্ত সাধনা করতে পারবে। নির্বাণ লাভেচ্ছু ভিক্ষু শ্ৰমণ আমার
নির্দেশিত পথে চললে অচিরেই। অনাগামী ও অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত এবং উপাসক-উপাসিকারা
শ্রোতাপত্তি ও সকৃদাগামী ফলে প্রতিষ্ঠিত হতে নিশ্চয়ই পারবে?
পূর্ব
পাপ ধ্বংস কর নব কর বন্ধ!
ভন্তের
পথে চলে নির্বাণের সম্বন্ধ।
কঠিন চীবর দানোৎসবে দেশনা
তাঁর
দেশনার প্রারম্ভে বলেন,
বুদ্ধের
শিক্ষা কাকে বলে?
শীল,
সমাধি ও প্রজ্ঞা।
উপর
বুদ্ধের শাসন কি?
অপ্রমাদই
বুদ্ধের শাসন।
ধর্ম
কথা কি?
চারি
আর্য সত্যকে ব্যাখ্যা করা ধর্ম কথা।
বুদ্ধের
দেশনা কি?
সাইত্রিশ
প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম সমূহ পুংখানুপুংখরূপে ব্যাখ্যা করতে পারাই দেশনা বলা হয়।
ত্রিবিধ
শিক্ষা কি?
শিল
শিক্ষা, সমাধি শিক্ষা ও প্রজ্ঞা শিক্ষা।
ত্রিবিধ
অভ্যাস কি? .
শীল
অভ্যাস, সামাধি অভ্যাস ও প্রজ্ঞা অভ্যাস।
ত্রিবিধ
পুরণ কি?
শীল
পুরণ, সামধি পুরণ ও প্রজ্ঞা পুরণ।
যতদিন
পর্যন্ত,পাপ কলুষ ধ্বংস না হয় ততদিন যাবৎ শীল শিক্ষা করতে হবে। যেমন ১। প্রাণী
হত্যা ২। চুরি ৩। ব্যাভিচার ৪। মিথ্যা কথা ৫। পিশুন ৬। কর্কশ ৭।সম্প্রলাপ
৮।
অন্যায় জীবিকা (পাপ জীবিকা)
এইগুলি শিক্ষা করার পর শীল অভ্যাস করতে হবে।
এবং পরে শীল পুরণ করে পাপ কলুষ ধ্বংস করতে হবে। সমাধি শিক্ষাঃ- যতদিন পর্যন্ত
উদ্ধত স্বভাব ধ্বংস না হয় ততদিন পর্যন্ত সমাধি শিক্ষা করতে হবে। (পঞ্চনীবরণ)
(পর্যটন ক্লেশ) যথাঃ-১। কামছন্দ ২। ব্যাপাদ ৩। ঔদ্ধত্য-(কৌকৃস্ত্যচার স্তৈনমিদ্ধ
৪। বি-চিকিৎসা। এইগুলি শিক্ষা করার পর সমাধি অভ্যাস করতে হবে এবং পরে সমাধি পুরণ
করে পর্যটন ক্লেশ ধ্বংস করতে হবে।
প্রজ্ঞা শিক্ষাঃ- যতদিন পর্যন্ত সপ্ত অনুশয়
ধ্বংস না হয় ততদিন পর্যন্ত প্রজ্ঞা শিক্ষা করতে হবে (অনুশয় ক্লেশ) যথা ১। কামরাগ
২। ভাবরাগ ৩। মানানুশয় ৪। দৃষ্টি ৫। প্রতিঘ ৬। বি-চিকিৎসা ৭। অ-বিদ্যা।
এসব অনাগত ক্লেশও বলা যেতে পারে। কেননা আরভমাণ
পেলে উহারা জেগে উঠে। এরা সব সময় সুপ্ত অবস্থায় থাকে।
এগুলি শিক্ষা করার পর প্রজ্ঞা অভ্যাস করতে
হবে এবং পরে পুরণ করে সপ্ত অনুশয় ধ্বংস করতে হবে।
কামছন্দঃ-
কামভোগ করলে অপরের লাঞ্ছনা গঞ্জনা ভোগ করতে হবে।
দুঃখ
নিরোধেঃ- সৎকায় দৃষ্টি উচ্ছেদ হয়।
সমুদয়
নিরোধেঃ- উচ্ছেদ দৃষ্টি উচ্ছেদ হয়।
মার্গসত্য
নিরোধেঃ- অক্রিয়া দৃষ্টি উচ্ছেদ হয়।
সৎকায়
দৃষ্টিঃ- পঞ্চ স্কন্ধে আমি আছি বা আমার।
উচ্ছেদ
দৃষ্টিঃ- বহুদোষ পূর্ণ, একগুয়ে, পুনঃ জন্ম নাই। মরলে দুঃখও নাই।
মরলে
সব শেষ হয়।
শ্বাশ্বত
দৃষ্টিঃ- কিছু ধার্মিক পরকালও বিশ্বাস করে। তাদেরকে বুঝানো খুবই কঠিন।
অক্রিয়া
দৃষ্টিঃ- দান, শীল, ভাবনা ও পাপ পূণ্যের বিশ্বাস নাই। আমার
দেশনাগুলি
কারো কারো খারাপ লাগে, অসুবিধা লাগে কারণ যারা
লোভ,
দ্বেষ ও মোহগ্রস্ত হয়ে ধর্ম শ্রবণ করে তাদের অসুবিধা লাগবে।
উপমাঃ-
জ্বর ভোগ করে যদি কেহ যে কোন খাবার খায় তবে তার পক্ষে সব
খাবার
তিতো লাগবে। খাবার তিতো লাগে, জিহ্বার স্বাদ নষ্ট হয়, সেরূপ লোভ দ্বেষ মোহপূর্ণ
ব্যক্তি আমার দেশনায় অসুবিধে অনুভব করবে।
পর্যটকের সাথে বনভন্তের আলাপ
১৯৮২ সালে যখন বৃটেন এবং
আর্জেন্টিনার সাথে ফোল্যান্ডে যুদ্ধ চলছিল ঠিক সেই সময় চারজন ফরাসী নাগরিক
রাংগামাটিতে পর্যটনের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে দু'জন পুরুষ ও দু জন মহিলা
একজন চাকমা দোভাষী সহ তারা বন বিহার পরিদর্শন করার জন্য এসেছিলেন। বন ভন্তের সংগে
অনেক আলাপ করার পর কথা প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত প্রসঙ্গগুলি আলোচিত হয়।
১ম
পুরুষঃ আপনি কি পৃথিবী সম্বন্ধে জানেন?
বন
ভন্তেঃ জানি ও জানিনা।
১ম
পুরুষঃ তা কি রকম?
বন
ভন্তেঃ ইচ্ছা করলে জানতে পারি। ইচ্ছা না হলে জানিনা।
১ম
পুরুষঃ তা কি রকম?
বন
ভন্তেঃ প্রয়োজনবোধে জানি।
১ম
পুরুষঃ ফোল্যান্ডে যে যুদ্ধ চলছে তা আপনি কি জানেন?
বন
ভন্তেরঃ হ্যা জানি।
২য়
পুরুষঃ আপনি কোন পক্ষকে সমর্থন করেন?
বন
ভন্তেঃ কোন পক্ষকে না।
২য়
পুরুষঃ আচ্ছা, কোন পক্ষ জয়ী হবে?
বন
ভন্তেঃ এ প্রশ্নটি সাধারণ লোকের নিকট উত্তর পাবেন।
২য়
পুরুষঃ তা কি রকম?
বন
ভন্তেঃ সাধারণ লোক যে কোন এক পক্ষকে সমর্থন করে। বন ভন্তে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন,
আপনারা কোন পক্ষকে সমর্থন করেন?
২য়
পুরুষঃ আমরা বৃটেনকে সমর্থন করি।
বন
ভন্তেঃ আপনাদের মত সাধারণ লোক যে কোন একপক্ষকে তো সমর্থন করবেনই। এ পৃথিবীতে যারা
যুদ্ধ বিগ্রহ করে তারা সাধারণ ও হীন।
২য়
পুরুষঃ তা হলে বৃটেনও হীন?
বন
ভন্তেঃ হা,হীন এ কথা আপনারা দেশে গিয়ে বলবেন। যারা অসাধারণ ও মহৎ তাঁরা কখনও
যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হন না।
১ম
মহিলাঃ আমি পৃথিবীর প্রায় জায়গায় ভ্রমন করেছি। এমনকি যে জায়গা একটু ভাল লেগেছে
সেখানে কয়েক বার গেছি।
বন
ভন্তেঃ ভ্রমণ করাতে কষ্ট হয় না?
১ম
মহিলাঃ হা কষ্ট হয়।
১ম
মহিলাঃ দর্শনীয় জায়গার মধ্যে বৌদ্ধ তীর্থ স্থানগুলি আমার খুবই ভাল লাগে। কেন যে
ভাল লাগে তা বলতে পারেন?
বন
ভন্তেঃ দর্শনীয় জায়গার মধ্যে বৌদ্ধ তীর্থগুলি নিরিবিলি এবং কোলাহল মুক্ত। অন্য
কারণ হলো, আপনার বোধ হয় পূর্ব জন্মের বৌদ্ধ সংস্কারও থাকতে পারে।
২য়
মহিলাঃ আপনি কত বৎসর সাধনা করে আসছেন?
বন
ভন্তেঃ পয়ত্রিশ বৎসর যাবৎ।
২য়
মহিলাঃ সুদীর্ঘ সময়ে আপনি কি অভিজ্ঞতা লাভ এবং অনুভব করেছেন?
বন
ভন্তেঃ সত্য সমূহকে উপলব্ধি এবং অবিদ্যা-তৃষ্ণাকে ধ্বংস করে নিরোধ জ্ঞান অনুভব
করছি।
বন ভন্তের সাথে ফরাসী
পর্যটকরা আলাপ করে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলেন।
বন ভন্তের শাসন পদ্ধতি
বন বিহারে একজন শ্রমণ হলে একজন ধুতাঙ্গধারী শ্রমণের যা
যা প্রয়োজন বন ভন্তে ক্রমান্বয়ে পুংখানুপুংখরূপে তা ব্যাখ্যা করে থাকেন। দশশীলের
বিশদ ব্যাখ্যা এবং ৭৫টি শেখিয়া ধর্ম সম্বন্ধে অবহিত করেন। প্রত্যেক দিন ভোর
পাঁচটায় এবং সন্ধ্যার পরে ভিক্ষু শ্রমণদিগকে নিত্য প্রয়োজনীয় কর্মস্থান সম্বন্ধে
ধর্মদেশনা করে থাকেন। প্রত্যেক অমাবস্যায় ও পূর্ণিমার উপপাসথের দিন সীমা ঘরে তাঁর
শিষ্য ভিক্ষুদেরকে বিনয় শিক্ষা প্রদান করেন। যদি কেহ বিনয় লংঘন করে থাকে এক
ঘন্টা পর্যন্ত রৌদ্রে দাঁড় করান, বোধিবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালা এবং বিভিন্ন
শাস্তির বিধান করে থাকেন। প্রত্যেক ভিক্ষু শ্রমণদিগকে রাত এগারটা হতে রাত তিনটা
পর্যন্ত ঘুমানোর নির্দেশ অবশ্যই পালন করতে হয় যদি কেহ গুরতরবিনয় লংঘন করে থাকে,
সংগে সংঘেই শ্বেত বস্ত্র পরিধান করিয়ে বহিস্কার করেন। বন ভন্তের শিষ্য ভিক্ষু শ্রমণদের
অনেক বহিস্কৃতের মধ্যে একটা উদাহরণ দিচ্ছিঃ
এক বার এক যুবক শ্রমণ কোন এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাঙ্গামাটির
বিশিষ্ট এক মহিলার প্রতি এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎ শ্রমণের প্রতি বন ভন্তের চোক
পড়ল। ঠিক দুই দিন পর শ্রমণকে ডেকে রসিকতার সহিত জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি রাঙ্গামাটির
কোন্ কোন্ মহিলাকে চিনো? শ্রমণ কয়েকজনের নাম বলার পর বললেনঅমূক মহিলাকে চিনো
নাকি? হ্যা, ভন্তে, চিনি। সে সুন্দরী কিনা? হ্যা, ভন্তে, তা হলে তুমি একটা কাজ কর,
সাদা কাপড় পড়ে এস। শ্রমণের বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত পঞ্চশীল গ্রহণ করে চলে গেল।
এখানে ভন্তে দেখতে পেলেন যে এ ব্যাপারে সহজে সংশোধন হবেনা এবং ভবিষ্যতে সমস্ত
ভিক্ষু শ্রমণও বন বিহারের নিয়ম লংঘন করতে সাহস পাবে না।
বনভন্তে কি রাগী
?
আপনারা বোধ হয় কেহ কেহ জানেন আমি শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের মুখ নিঃসৃত
ধর্মদেশনাগুলি আমার সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছি। বন
ভন্তের দেশনাগুলি লিপিবদ্ধ করতে হলে তিনটি বিষয় সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান থাকা দরকার।
এই তিনটির মধ্যে প্রথমে গভীর লোকোত্তর জ্ঞানের দরকার, দ্বিতীয় সুতীক্ষ্ম স্মৃতি
শক্তির অধিকারী হওয়া এবং তৃতীয়তঃ বাংলা ভাষার উপর দক্ষতার প্রয়োজন।
এ তিনটি বিষয়েই আমার যৎ সামান্য ধর্ম জ্ঞান, স্মৃতি শক্তি ও ভাষা
জ্ঞান দিয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের একটি বিষয়ে দেশনার ভিত্তি করে আপনাদের নিকট
প্রবন্ধাকারে বিষয়টি উপস্থাপন করছি। বিষয়টি হল-বন ভন্তে কি রাগী? কেহ কেহ মনে
করেন।
শ্রদ্ধেয় বনভন্তে সবকিছু
ত্যাগ করেছেন কিন্তু রাগ ত্যাগ করতে পারেন নি। গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করলে
এবং বন ভন্তের মুখ নিঃসৃত এই বিষয়ের উপর দেশনা যাঁরা শুনেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন
এটি তার রাগ নয়, বিনয় সম্মত বুদ্ধের অনুশাসন। বন ভন্তে ইচ্ছা করেন যে, বৌদ্ধ
ধর্ম অনুসারীরা তাঁদের চিন্তায়, বাক্যে ও কর্মে যেন ধর্মের সামান্যতম পরিহানী না
করে কেননা বিন্দু বিন্দু জলের ফোটায় যেমন বিশাল সাগরের সৃষ্টি হয় তেমনি ধর্ম
আচরণে ফাঁক থাকলেও ধর্মের গ্লানি হবে এবং ক্রমে ক্রমে এই অভ্যাস বিশাল আকার ধারণ
করে ধর্ম ও সংঘকে কলুষিত করবে। সে জন্য ধর্মের অনুশাসন রক্ষার্থে বন ভন্তে সময়
সময় কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন। বিষয়টিকে আরো পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করার জন্য
নিম্নে দুটি উদাহরণ তুলে ধরছি। তা হতে আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন ইহা শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তের রাগ নয় লোক শিক্ষার জন্য অনুশাসন মাত্র। প্রথম উদাহরণঃ-
একদিন আমি বুদ্ধ বন্দনা করার পর আমার অজ্ঞানতা বশতঃ একখানা ধর্মীয়
পুস্তক নীচে (ফ্লোরে) রেখে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে বন্দনা করার উদ্যত হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে তিনি দাঁড়িয়ে বললেন- তুমি আমাকে বন্দনা করনা বুদ্ধকে অবমাননা করে আমাকে
বন্দনা করবে কেন? তুমি জাননা বুদ্ধের অবর্তমানে বুদ্ধের ৮৪ হাজার ধর্ম স্কন্ধই
স্বয়ং বুদ্ধ স্বরূপ? আমাকে বন্দনা করার প্রয়োজন নেই। উপস্থিত উপাসক উপাসিকারা
হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। আমি পুস্তকটি টেবিলের উপর রেখে বললাম-ভন্তে আমার ভুল
হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন। তারপর বন ভন্তে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘকে কিভাবে সম্মান ও
মর্যাদা দিতে হয় তা উপদেশ দিয়ে আমার ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন। তিনি এরকম পদক্ষেপ
না নিলে আমার জীবনেও শিক্ষা হতো না। দ্বিতীয় উদাহরণঃ শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে কোন
জায়গায় কেহ আমন্ত্রণ করলে আমন্ত্রণের দিন সঠিক সময় এবং গাড়ীর সংখ্যা ডায়েরীতে
লিখে দিতে হবে। অবহেলা অথবা ভুলক্রমে দেরীতেউপস্থিত হলে এবং গাড়ীর সংখ্যা কম হলে
বন ভন্তে সেদিন অনুষ্ঠানে যাননা। তাঁর ভাষায় আমার ধ্যান সমাধিত অথবা ধর্মে কোন
কৃত্রিমতা নেই। কত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে অভিজ্ঞান লাভ করেছি। তোমাদের কাজে ও কথায়
মিল নেই কেন? তোমাদের ভেজাল ধর্মে যাবনা। অনেক জায়গায় কথা আর কাজে অমিল থাকাতে
তিনি অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি। সে সময় কেহ কেহ পুনঃ পুনঃ অনুরোধ বা প্রার্থনা
করলেও সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
একবার বন বিহারে বাইরে দুই জন ভদ্রলোক চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে
লাগলেন-আমাদের লোকদেরকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবো? হয়তো আমাদেরকে মারতেও পারে। আমি
আর বাবু অনিল বিহারী চাক্মা তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বল্লাম-আপনারা একটু অপেক্ষা
করুন দেখি, আমরা বন ভন্তেকে বুঝিয়ে নিতে পারি কিনা। অতঃপর আমরা বন ভন্তেকে বন্দনা
করে অনুরোধ করার সাথে সাথেই তিনি বলে উঠলেনঅনুরোধ করো না, অনুরোধ করোনা। আমরা
বললাম, ভন্তে ভুল যখন হয়েছে, আর কি করা যায়? ক্ষমা করে সেখানে যাওয়া ভাল মনে
করি। ভন্তে তৎক্ষণাৎ আসন হতে . উঠে বলেন-ভেজালের জন্য অনুরোধ করোনা। বিহার হতে বের
হয়ে যাও। আমরা বিহারের উঠানে দাড়িয়ে হাত জোড় করে আছি। তিনি আবার বললেন-বিহার
এলাকা হতে চলে যাও। তারপর আমরা চলে যাওয়ার সময় ছোয়াইং ঘরে বসে রইলাম। আর একদিন
বন ভন্তে দেশনা প্রসঙ্গে বললেন-তোমাদের অনুরোধে যদি সেদিন যেতাম, দায়কদের অভ্যাসে
পরিণত হত। ভেজাল আমার সহ্য হয়না। ভেজাল কি? নির্ভেজাল কি? তা পারমার্থিক ভাবে
তিনি বুঝিয়ে দিলেন। পরিশেষে বুঝতে পারলাম বন ভন্তের এটা রাগ নয় অনুশাসন মাত্র।
আমার মনে হয় অন্য কেহ বন বিহারের ধারে কাছেও আসতোনা। যেমন বর্তমানে কেহ কেহ ভুল
ধারণা বশতঃ বন বিহারে আসেনা।
অনেক সময় বনভন্তে বলেন, আমার রাগটা কি রকম জান? ডাক্তারের ফোঁড়া
অপারেশন করা, শিক্ষকের দোষী ছাত্রকে শাস্তি প্রদান করা ও কর্মকারের লোহা। পিটানোর
মত। তিনি আরো বলেন, মার তাড়াতে হলে জোর গলায় বা শক্ত ভাবে না বলে হয়না। অনেকে
মনে করে এটা বন ভন্তের রাগ, আসলে তা রাগ নয়। এতে প্রমাণ হয় যে বন ভন্তে
রাগশূণ্য। রাগ প্রকৃতির লোক সব সময় রাগ দেখায় কিন্তু বন ভন্তের বেলায় তা নয়
যেখানে ভুল, ত্রুটি, দোষ অথবা গুরুতর অপরাধ পরিলক্ষিত হয় সেখানে তিনি সঙ্গে সঙ্গে
বজ কণ্ঠে শিক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।
বন ভন্তে কি রাগ
মুক্ত?
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে মহোদয়কে কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ
করলে এবং তাতে তিনি অনুমোদন দান করলে আমন্ত্রণের তারিখ, সময় ও যানবাহনের সংখ্যা
ডায়েরীতে লিখে দিতে হয়। ডায়েরীতে লিখা অনুযায়ী শর্ত পূরণ না হলে তিনি প্রায়
আমন্ত্রণে যান না বিশ্লেষণে তিনি বলেন-কথা আর কাজে মিল থাকা দরকার। ভেজালে আমি যাব
কেন? আমি কোন কাজে বা কথায় ভেজাল দিই না। একবার মাঘ মাসের কনকনে শীতের দিনে
মহামুনি পাহাড়তলী হতে বন ভন্তেকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। ভন্তের জন্য দুইখানা মোটর
কার এবং গৃহীদের জন্যে একখানা কোচের ব্যবস্থা করা হল। অনুষ্ঠানের আগের দিন বেলা
দুই ঘটিকায় রওনা হওয়ার সময় নির্ধারিত হল। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে নদীর ঘাটে এসে,
গাড়ী দেখে বললেন-আমি যাব না। দুইটা কার আনার কথা, একটা কার ও একটা জীপ এনেছ। তোমাদের
কথা ও কাজে মিল নেই, এই বলে তিনি বিহারে চলে গেলেন। আমি সহ বহু লোকে অনুরোধ করার
পরও তিনি যেতে রাজী হলেন না। তিনি শুধু বলেন- আগামীকাল সকাল বেলা পাঁচখানা কার
আনলে আমি যেতে পারি। বনভন্তে এই কথা বলার পর পাহাড়তলীর উপাসকেরা সঙ্গে সঙ্গে রাজী
হলেন। এদিকে আমাদিগকে বলে দিলেন-তোমরা আজকে চলে যাও। সন্ধ্যার সময় গিয়ে দেখি শত
শত ধর্মপ্রাণ নারী পুরুষ বনভন্তের আগমনের অপেক্ষায় আছেন। তাঁকে না দেখে সবার
চেহারা সঙ্গে সঙ্গে মলিন হয়ে গেল।
রাত দুইটার পাহাড়তলীর জনৈক উপাসক আমাকে ঘুম থেকে ডেকে
বললেনঅনুগ্রহ পূর্বক চলুন আমার সাথে। রাত তিনটায় যাত্রা করলাম। কুয়াশার জন্যে পথ
দেখা যাচ্ছে না। খুব ভোরে রাণীর হাট এসে চা পান করে ভোর ছয়টায় বন বিহারে পৌছি।
সকাল নয়টায় মহামুনি বিহারে পৌঁছার পর বিপুল সংখ্যক উপাসক-উপাসিকা
সাধুবাদ ধ্বনিতে বিহার এলাকা মুখরিত করলেন। প্রথমেই তিনি কাজে রত জনৈক উপাসককে
জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি কতটুকু লেখাপড়া করেছ? উপাসক বলেন-অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত।
ভন্তে বলেন-তাহলে তুমি এখান থেকে চলে যাও। এম, এ, পাশ ব্যতীত কেহ আমার
অবস্থানকালীন সময়ে কাজ করতে পারবেনা। উপস্থিত ক্ষেত্রে পাওয়া গেল দুইতিন জন এম,
এ পাশ লোক মাত্র। বিকাল বেলা সাত আট জনে দাঁড়াল। আমি একজনের মত জিজ্ঞাসা করে
দেখতে পেলাম তিনি খুব খুশী। বললেন-তিনি এরকম না বললে আমরা পূণ্যাংশ থেকে বাদ
পড়তাম। তাতে আমি বুঝলাম ভগবান বুদ্ধও সেরকম শাক্যদেরকে প্রথমেই মান ভঙ্গ
করেছিলেন। এ ঘটনা পাহাড়তলীতে ছড়িয়ে পড়ার পর জনমনে অসন্তোষের পরিবর্তে বেশ
আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। সকাল বেলা যথাসময়েসংঘদান, বিকালে ধর্মসভা ও রাত্রে
সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ মঞ্চস্থ হয়। পরের দিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধানের
জন্য কয়েকজন শাস্ত্রজ্ঞ উপাসক বন ভন্তের সমীপে উপস্থিত হন। প্রথমে তাঁরা প্রশ্ন
করেন- আমাদের ধারণামতে আপনি লোভ, দ্বেষ, মোহ ত্যাগ করেছেন। তার প্রমাণ আপনি টাকা
পয়সা স্পর্শ করেননা এমনি কি বহু বৎসর যাবৎ ধ্যান সাধনা করেছেন। আমাদের মতে আপনি
রাগ ত্যাগ করেন নি? বন ভন্তে একটু হেসে বলেন-গাড়ীর ব্যাপারে। তারপর বন ভন্তে
বললেন-মন দিয়ে শুনুন, যদি ঐদিন সে গাড়ী যোগে আসতাম, আর একদিন আপনারা একখানা
ভাঙ্গা জীপ নিয়ে আসতেন। এটা অভ্যাসে পরিণত হতো। এরকম করার উদ্দেশ্য হল আপনাদেরক
শাস্তি দেওয়া। ভবিষ্যতে যেন এরকম পুনরাবৃত্তি না ঘটে। দ্বিতীয়তঃ শিক্ষক ছাত্রকে
অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়ে থাকেন। তৃতীয়তঃ চিকিৎসক্ত রোগীর ফোঁড়া অপারেশন করলে
রাগ ধরা যায়না। তদ্রুপ ঐদিন আমার ঐরূপ নির্দেশ ছিল। ইহা আপনাদের অপরাধের জন্য
শিক্ষামূলক শাস্তির ব্যবস্থা মাত্র।
তিনটি উপমামূলক দেশনা করার পর উপসকরা সন্তুষ্ট হন। তারপর শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তে চতুর্থ উপমা দিয়ে বললেন-ভগবান বুদ্ধের সময়ে পাচশত তীর্থীয় সন্ন্যাসী
বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁরা একদিন বুদ্ধ দর্শনের উদ্দেশ্যে শ্রাবস্তীর জেতবন
বিহারে উপস্থিত হয়েছেন। সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। ভগবান দেশনায় রত আছেন। নবদীক্ষিত
ভিক্ষুরা বিনয় না জেনে কোলাহল করায় তাদেরকে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।
ভিক্ষুরাও কেঁদে কেঁদে বিহার থেকে বাহির হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বিহারের সামনে
জনৈক শাক্যপুত্র যুবক জিজ্ঞাসা করলেন-ভদন্তগণ, আপনারা এই মাত্র এসে পুনারায় চলে
যাচ্ছেন কেন? উত্তরে বলেন-ভগবান আমাদেরকে বহিস্কার করেছেন। যুবক উৎকণ্ঠিত হয়ে
বললেন-আপনারা একটু দাঁড়ান। ভগবান বুদ্ধ আমার গোত্রীয় ভাই তাকে বুঝায়ে আপনাদিগকে
পুনরায় নিয়ে যাব। তারপর যুবক ভগবান বুদ্ধকে বন্দনা করে বলেনভন্তে, অনুগ্রহ
পূর্বক নব দীক্ষিত ভিক্ষুদের অপরাধ ক্ষমা করুন। যদি তারা চলে যান পুনারায় তীর্থয়
হয়ে যাবেন। যুবকের সুপারিশে ভগবান নীরব রহিলেন। তারপর ভগবান বুদ্ধের সেবক আনন্দ
বলেন-ভগবান, আপনি তীথীয়দের মাতা সদৃশ,সদ্যজাত শিশুকে মা দুগ্ধ দান না করলে শিশু
মারা পরবে। ভগবান তাতেও নীরব রহিলেন। তারপর স্বর্গের ইন্দ্র রাজা বলেন-ভাগবান
অংকুর হতে উথিত চারাগাছ জল না পেলে বাঁচবেনা, তীৰ্থীয়গণ চারা সদৃশ। ভগবান তাতেও
নীরব রহিলেন। সর্বশেষে সারিপুত্র মোদগলায়ন এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
তখন ভগবান বুদ্ধ তাদিগকে বললেন-কি জন্যে তাদেরকে বহিস্কারের
নির্দেশ দিয়েছি জান? তারা উত্তর দিলেন-নব দীক্ষিত ভিক্ষুগণ অজ্ঞ বলে শাস্তি
স্বরূপ বহিস্কার করেছেন। অবশেষে ভগবান বুদ্ধ তাদেরকে ডেকে আনার জন্য নির্দেশ দেন।
নবদীক্ষিত ভিক্ষুগণ ভগবান সমীপে আসার পর যে ধর্ম দেশনা দেয়া হয় তাতে তারা সঙ্গে
সঙ্গে অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আকাশ পথে অন্য বিহারে চলে যান।
এ পরিশেষে বন ভন্তে
বললেন-আচ্ছা, এখন আপনারা বলুন, ভগবান বুদ্ধ কি রাগ করেছেন না তাদেরকে শিক্ষা
দিয়েছেন? উত্তরে উপাসকরা বলেন-শিক্ষা দিয়েছেন। পুনরায় বন ভন্তে বলেন-তা হলে
আমার রাগ কোথায়? বন ভন্তের ধর্ম দেশনায় তাঁরা খুব সন্তুষ্ট হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা
করেন। তার পর উপাসকরা আরো তিন চারটা প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেয়ে রাত এগারটায় সকলে
বন্দনা করে চলে যান।
রাগ রূপে শিক্ষা হয় বুঝহ সুজন।
অন্যথায়
অন্য অর্থ বুঝিবে কুজন।।।
রসিকতায়
(শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের) উপদেশ
- প্রায় দেখা যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয়
বনভন্তে উপাসক উপাসিকাদিগকে গভীর তথ্যমূলক ও লোকোত্তর ধর্ম দেশনা করে থাকেন। মধ্যে
মধ্যে দেখা যায় বাস্তব উদাহরণ সহ রসিকতায় উপদেশ দিয়ে থাকেন। তাতে মূল রহস্য
উৎঘাটন ও জ্ঞান অর্জনের সহায়ক হয়।
১। একদিন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন- আচ্ছা তুমি
যদি ভিক্ষু হও, তোমার স্ত্রী তোমার চায় ভুলে যদি চিনি না দেয় তাকে লাঠি দিয়ে
মারবে নাকি? আমি একটু চিন্তা করে বললাম যদি আমি ভিক্ষু হই আপনার নিকটই হব। এখানে
মারামারির সুযোগ কোথায়? তারপর ভন্তে বললেন- জনৈক বৃদ্ধ ভিক্ষুর গৃহী কালের স্ত্রী
তার চা-এ ভুলে চিনি না দেওয়ায় খুব মার ধর করেছে। “যারা হীন ও নীচ প্রকৃতির তারা বিনয়ের বহির্ভূত কাজ করে
থাকেন।”
২। আর একদিন তার যুবক, শিষ্য ভিক্ষু শ্রমণদেরকে দেখিয়ে বলেন-এগুলি
আমার হাতীর দাত। হাতীর দাঁত কেমন জান? হাতীর দাত অত্যন্ত গোপনীয় জিনিষ। হাতীর
দাঁত দারোগা থেকে লুকিয়ে রাখি। শিষ্যের দিকে লক্ষ্য করে বললেন- নারী দারোগাকে ভয়
করো। কোন সময় নারী দারোগা কপাল পোড়া দেয়। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আর বলেন-এ
বুড়া ভিক্ষু আমার ছাগলের শিং দারোগা কেন কারো প্রয়োজন নেই।
তারপর তিনি আরো উপদেশ দিয়ে বলেন-“বাঘকে ভয় করােনা নারীকে ভয় করো।” বাঘ তোমাদের রক্ত মাংস খাবে
আর নারী খাবে তোমাদের জ্ঞান-পূণ্য। বিদ্যুৎ স্পর্শ করলে তোক মারা যায়। তেমনি
ভিক্ষু শ্রমণ নারী স্পর্শ করলে ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়।
তাল গাছের আগা ভেঙ্গে যাওয়া
আর ব্রহ্মচর্য নষ্ট করা একই কথা। সাপে কাটলে লোক মারা যায়। নারীর সংস্পর্শে
ভিক্ষু শ্রমণের অপায় গতি ব্যতীত অন্য উপায় নেই।
৩। আর একদিন ভোর বেলায় শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে জনৈক বুড়া শ্রমণকে
লক্ষ্য করে বলেন-ভগবান বুদ্ধের সময়েও তোমাদের মত বুড়া শ্রমণ ছিল। কেহ কেহ ধ্যান
সমাধি করে অগ্রফলের অধিকারী হন। কেহ কেহ তোমাদের মতো গল্প আলাপ করে সময় অতিবাহিত
করে যা তা রয়ে যায়। হঠাৎ একদিন বুড়া শ্রমণদের কাঁদতে দেখে এক ভিক্ষু তাদের
কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। অন্য এক বুড়া শ্রমণ উত্তরে বললেনএই শ্রমণের গৃহী
কালের স্ত্রী মারা গেছে। তা শুনে উক্ত ভিক্ষু বললেন-তাতে কি আসে যায়? শ্রমণ হয়ে
কান্না করা শোভা পায় না। সেই শ্রমণ আবার বলেন-তার স্ত্রী খুব ভাল উপাসিকা ছিল, ভালো
ভালো খাদ্য ও পিঠা নিয়ে আসত, আমরা সবাই বসে বসে আহার করতাম। এখন থেকে আর খেতে
পারবনা সেজন্য বসে বসে কাঁদছি।
এ গল্পটি বলার সাথে সাথেই আমরা হেসে উঠলাম। তারপর বন ভন্তে বললেন“যৌবন কালে মানুষের পাওয়ার
ইচ্ছা হল নারী, আর বুড়া কালে খাওয়ার ইচ্ছা বিভিন্ন প্রকার খাদ্য দ্রব্য। তাদেরও
খাওয়ার ইচ্ছা আছে, তা কি জান? আসক্তি ত্যাগ না করলে মুক্তি পাবে না।” তিনি আবারও রসিকতা করে
বললেন-আচ্ছা, যদি তোমাদের ঘরের বুড়ী মারা যায়, শুনে কান্না করবে নাকি? আমরা হেসে
বললাম-তা কি করে হয়? লজ্জার ব্যাপার। এ ভাবে অনেক সময় শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে
রসিকতার ভিতর দিয়ে উপাসক উপাসিকা এবং ভিক্ষু শ্রমণদেরকে উপদেশ দিয়ে থাকেন।
হাসি নহে খুশা নহে নহে
রসিকতা।
হাসিতে খুশীতে জ্ঞান আর
শিক্ষকতা।।

ত্যাগেই সুখ
দেশনার প্রারম্ভে বললেন-একটা বাগান করতে হলে প্রথমে বন-জঙ্গল কাটতে
হয় এবং সেগুলির মূল উৎপাটন করতে হয়। পরে লতা পাতা ঘাস ইত্যাদি পরিস্কার করতে
হয়। পরিশেষে শস্যাদির চারা রোপণ করতে হয়। তেমনি পরম সুখ নির্বাণ লাভ করতে হলে
প্রথমে ত্যাগ করতে হবে এবং পরিশেষে দমিত হয়ে পরম সুখ নির্বাণ লাভ করতে হয়।
ত্যাগে কি হয় জানতে হবে। ত্যাগ কে কে করেছে, কি কি ত্যাগ করেছে,
কি কি ফল লাভ করেছে ? তোমাদেরও সে রকম ভাবে ত্যাগ করতে হবে।
প্রথমে পঞ্চ আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। যেমন কামাসক্তি, কর্মাসক্তি,
নিদ্রাসক্তি, ইন্দ্রিয়াসক্তি, মিত্রাসক্তি। ১। কামাসক্ত কোন কোন ব্যক্তি যৌন
বিষয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে থাকে। এরকম হীন আচরণে মানুষের মুক্তির পথে এক বিরাট বাঁধার
সৃষ্টি হয়। সুতরাং কামাসক্তি ত্যাগ করা একান্ত উচিৎ।
২। কর্মাসক্ত ব্যক্তি সারাদিন-রাত, সপ্তাহ-মাস, বৎসর এবং সারা জীবন
নানা কর্মে ব্যস্ত থেকে মুক্তির পথ পায়না। সুতরাং কর্মাসক্তি ত্যাগ করা প্রয়োজন।
৩। অনেক লোক দেখা যায় তারা অধিকাংশ সময় শুধু ঘুমায়ে ঘুমায়ে
কাটায়। তারা কোন কারাগারে আছে জানেনা। কাজেই মুক্তির পথ খুঁজতে হলে নিদ্রাসক্তি
ত্যাগ করা দরকার।
৪। কোন কোন লোক দেখা যায় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অত্যধিক আসক্ত। তারা
চক্ষুদ্বারা সুদর্শনীয় বস্তু গ্রহণ করে লোভ মোহ পরায়ণ হয়। কর্ণ দ্বারা শ্রুতি
মধুর শব্দ গ্রহণ করে লোভ মোহ পরায়ণ হয়। জিহ্বা দ্বারা সব সময় ভাল দ্রব্যের
স্বাদ গ্রহণ করে লোভ মোহ পরায়ণ হয়। কায় বা ত্বক দ্বারা কোমল বা আরামদায়ক বস্তু
গ্রহণ করে লোভ মোহ পরায়ণ হয়। পঞ্চ আসক্তি বা লোভী ব্যক্তিরা তাদের ইন্দ্রিয় ভোগের
বিপরীত হলে দ্বেষ মোহ পরায়ণ হয়। তারা লোভ দ্বেষ, মোহ পরায়ণ হয়ে নানা দুঃখ ভোগ
করে এবং মুক্তির পথ অন্বেষণ করতে পারেন। সে জন্য ইন্দ্রিয় আসক্তি ত্যাগ করা উচিৎ।
৫। কেহ কেহ সব সময় সঙ্গী বা মিত্রদের সাথে নানা আলাপ করে সময়
কাটায়। তারা অমূল্য জীবন বা সময় সম্বন্ধে জানেনা। মিত্রাসক্ত ব্যক্তিরা মুক্ত কি
করে হয় তা বোঝেনা। সুতরাং মিত্রাসক্তি ত্যাগ করা একান্ত দরকার।
অবিদ্যাসক্তগণ দুঃখ যন্ত্রণায় পরে। অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা অবশ্যই
ত্যাগ করতে হবে, অবিদ্যায় চতুরার্য সত্য, কর্ম ও কর্মফলকে বুঝা বা জানার জন্য
বাধা হয়। অজ্ঞানের অন্ধকারে আবদ্ধ রাখে বলে একে ত্যাগ করা একান্ত প্রয়োজন।
তৃষ্ণাসক্তদেরকে জন্ম জন্মান্তরে নদীর স্রোতের মত একবার ভাসিয়ে
একবার ডুবিয়ে নানা জন্মে অসহ্য দুঃখ প্রদান করে। সুতরাং
যন্ত্রণাদায়ক তৃষ্ণাকে সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করা উচিৎ।
লৌকিক হীন সংস্কার বলতে সংসারের যাবতীয় লৌকিক কর্মকে বুঝায়।
মানুষ নানাবিধ হীন সংস্কারে জন্ম জন্মান্তরে ঘুরে ঘুরে নানা দুঃখ ভোগ করে। অতএব
হীন সংস্কার ত্যাগ করা দরকার।
কোন লোক হীন মনুষ্যত্বের দূরুন কুশল অকুশল জানেনা বা তাদের হিতাহিত
জ্ঞান থাকেনা। তারা মুক্তির পথ খুঁজে পায়না। সুতরাং হীন মনুষ্যত্ব ত্যাগ করা
একান্ত দরকার। " জাতীয়তাবাদে মানুষের
মনে হিংসা, নিন্দা ও ঘৃণার উদ্রেক হয়। এতে মন কলুষিত থাকে। কলুষিত মনে সত্য সমূহ
অবগত হওয়া যায়না। সুতরাং জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করা দরকার।
আত্মবাদী বা মানবাদী ব্যক্তিরা দেহের মধ্যে আমি নামে এক সংজ্ঞা
দেখতে পায়। তাতে রমিত হয়ে নানা লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ভোগ করে। নয় প্রকার মান
পরিত্যাগ করা একান্ত কর্তব্য।
লোভী ব্যক্তি মরণের পর প্রেতলোকে গমন করে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে।
সুতরাং লোভ ত্যাগ করা একান্ত দরকার।
হিংসা মানুষের চিত্তকে সব সময় কলুষিত রাখে। মৃত্যুর পর নরকে পতিত
হয়ে অনন্তকাল দুঃখ ভোগ করে। যন্ত্রণাদায়ক হিংসাকে ত্যাগ করা একান্ত প্রয়োজন।
এই দেহ অনিত্য, দুঃখপূর্ণ অনাত্ম, অশুচি, বহুদোষ পূর্ণ এবং মুক্তির
বিঘ্নকারক সুতরাং সাধু পুরুষেরা সর্ব দুঃখের আধার দেহকে ত্যাগ করে পরম শান্তিপদ
নির্বাণ লাভ করে থাকেন। যারা জ্ঞানী তাঁরা জীবনকে তৃণ তুল্যও মূল্য না দিয়ে সত্য
সমূহে প্রতিষ্ঠিত পরম সুখ নির্বাণ লাভ করেন সুতরাং মিথ্যা জীবিকা পরিত্যাগ করা
একান্ত প্রয়োজন। কুশল কর্মে লজ্জা ত্যাগ ও ভয় ত্যাগ,উদ্যমশালী হয়ে তন্দ্রা,
আলস্য ত্যাগ, কৃতকর্মের অনুশোচনা ত্যাগ করা একান্ত দরকার।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের ধর্ম আছে। তদৃমধ্যে পাপ ধর্ম ও পূণ্য ধর্ম
বিদ্যমান। পাপ ধর্ম অপায়ের দিকে নিয়ে যায় এবং পূণ্য ধর্ম স্বর্গের দিকে নিয়ে
যায়। পূণ্য ধর্মও ত্যাগ করা উচিৎ কারণ স্বর্গ ভোগ করার পরও অপায়ে পতিত হওয়ার
আশঙ্কা থাকে। যেমন দান করলে দানের ফল ভোগ করতে হবে। ফলের ভোগ যতদিন পর্যন্ত শেষ না
হয় তত দিন পর্যন্ত বিভিন্ন যোনিতে বা জন্মে পরিভ্রমণ করে নানা দুঃখ ভোগ করতে হয়।
সুতরাং পূণ্যধর্ম ত্যাগ করা উচিৎ।
মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন লোক সত্য পথে চলতে পারেনা বলে বিভিন্ন
মতবাদে জড়িত থেকে বহু দুঃখ পায়। মহা অনিষ্টকারীমিথ্যাদৃষ্টি ত্যাগ করা একান্ত
প্রয়োজন।
ত্রিরত্নের প্রতি অবিশ্বাস বা সন্দেহ পরায়ণ তাকে বি-চিকিৎসা বলে।
বি-চিকিৎসা থাকলে সত্য ধর্মে প্রবিষ্ট হতে পারে না। সুতরাং বি-চিকিৎসা ত্যাগ করা।
একান্ত প্রয়োজন।
ত্যাগ ধর্ম বলতে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা শীল সমাধি প্রজ্ঞাকে
বুঝায়। শীলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে শমথ এবং বিদর্শন ভাবনাকে বর্ধিত করলে ত্যাগ ধর্ম
পরিপূর্ণ হয়। ত্যাগ ধর্মে পরম সুখ নির্বাণ লাভ করা যায়। ত্যাগ ধর্ম মহা কঠিন
কিন্তু দুর্লভ নয়। ত্যাগ ধর্ম অনুশীলন করা প্রত্যেকের একান্ত প্রয়োজন।
ত্যাগ
কর ত্যাগ কর ত্যাগে মহাসুখ।
জমালে
জন্ম বাড়বে জন্মে মহাদুখ ।।
উচ্চ পদস্থ অফিসারের সাথে আলাপ
একদিন বন বিহারে জনৈক উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারী তার বন্ধু-বান্ধবকে
সংগে নিয়ে আসলেন। গেইটে অন্য সবাই জুতা খুলে রাখলেন কিন্তু তিনি খুললেন না। তিনি
বন বিহারে উঠতে প্রথম ধাপেই তার মন পরিবর্তন করে জুতা খুলে রাখলেন। দেশনালয়ে একজন
বললেন-ইনি আমাদের অমুক অফিসার। পরিচয়ের সাথে সাথেই বন ভন্তে বলেন মাথা হতে টুপি
নামিয়ে ফেলুন। একটু পরে টুপি নামিয়ে অফিসার বলেন আমি আপনাকে প্রশ্ন করব, উত্তর
দিবেন কি? বন ভন্তে ও প্রশ্ন করতে পারেন।
অফিসারঃ আচ্ছা, অহিংসা বৌদ্ধ ধর্মের সারমর্ম। আমি দেখি ইহা হিংসায়
পরিপূর্ণ।
বন ভন্তেঃ কি দেখে বললেন বুঝয়ে বলুন।
অফিসারঃ যেমন এ মাত্র আপনি আমার টুপি নামানোর জন্য বলেন। আমাদের
মসজিদে টুপি নেওয়ার বিধান আছে। এটা হিংসা নয় কি?
বন ভন্তেঃ আপনি কেন, রাজা মহারাজাদের পর্যন্ত আমাদের বৌদ্ধ বিহারে
রাজ মুকুট খুলে আসতে হয়। খোলা মাথায় বিহারে আসা আমাদের নিয়ম। এটি হিংসা নয়, যে
নিয়ম যেখানে প্রযোজ্য সেখানে সে নিয়ম মানা উচিৎ। আর কি প্রশ্ন আছে বলুন।
অফিসারঃ রাঙ্গামাটিতে এসে দেখলাম চামারা মাছ,
মুরগী, ছাগল, শুকর এমনকি মানুষ পর্যন্ত হত্যা করে। ইহা কি বৌদ্ধ ধর্মের নীতি?
বন ভন্তেঃ তারা বৌদ্ধ নয়।
অফিসারঃ তাহলে তারা কি?
বনভন্তেঃ তারা নামে মাত্র বৌদ্ধ। যেমন ধরুন,
হযরত মোহাম্মদ ইসলাম ধর্মের প্রচারক। তার নীতি অনুসারীকে মুসলমান বলে। আর যারা মদ,
লুটতরাজ, নারী নির্যাতন এবং নানাবিধ অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকে, তাদেরকে নামেমাত্র
মুসলমান। বলবেন, তা নয় কি?
অফিসারঃ হ্যা।
বন ভন্তেঃ যাঁরা ভগবান বুদ্ধের নীতি পালন করে
তাদেরকে বৌদ্ধ বলে অন্যেরা নামে মাত্র বৌদ্ধ ।
অফিসারঃ আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করা।
বন ভন্তেঃ একটা কেন, আপনার ইচ্ছামত প্রশ্ন
করতে পারেন। উত্তর দিতে প্রস্তুত। আছি।
অফিসারঃ আচ্ছা , যদি আপনাকে গালি অথবা কর্কশ
বাক্য বলি কি করবেন? বা কি বলবেন?
বন ভন্তেঃ (একটু হেসে) এ খুঁটি দেখছেন তো?
অফিসারঃ হ্যা।
বন ভন্তেঃ আপনি এ খুটিকে সারাদিন গালিগালাজ
অথবা কর্কশ বাক্য বলুন, খুঁটি যে ভাবে সাড়া না দিয়ে থাকে, আমিও খুঁটির মত চুপ
করে থাকব। কিন্তু একটা কথা আছে যারা সংসারে অজ্ঞানী ও মুর্খ তারা সবাইকে গালি অথবা
কর্কশ বাক্য প্রয়োগ করে। অন্যদিকে আপনাকে মনে করব একজন ছোট শিশু। ছোট শিশুরা কোলে
পায়খানা প্রস্রাব করে দেয়। ছোট শিশুকে ফেলে দেয় নাকি?
অফিসারঃ না।
বন ভন্তেঃ যে রকম ছোট শিশুকে পায়খানা ধোয়াইয়া
আবার কোলে তুলে নেয়। সেরূপ আপনাকেও ছোট শিশু তূল্য ধারণা করব।
তখন অফিসার মহোদয় আর প্রশ্ন না করে
দাঁড়িয়ে বললেন-আমাকে ক্ষমা করুন। এখন আমি আপনার নিকট ছোট শিশু।
বন ভন্তেঃ বস, বস, বস। তারপর বনভন্তে অফিসার
মহোদয়কে উপলক্ষ্য করে বহু উপদেশ প্রদান করলেন। সে সময় হতে তারাও খুব সন্তুষ্ট
হয়ে বন বিহারে যাতায়াত করতেন।
সঠিক প্রার্থনা
একদিন দেশনালয়ে কয়েকজন উপাসক সহ বনভন্তের দেশনা
শুনছি। এমন সময় ঘাগড়ার এক ভদ্রলোক বন্দনা করে বলে উঠলেন-ভন্তে, আমার পরিবারে
সর্বদা যে কোন একজন ভীষণ রোগে ভুগতে থাকে। রোগ মুক্তির জন্য আপনার নিকট আশীর্বাদ
প্রার্থনা করছি। বনভন্তে আমাকে বলেন-দেখত কি বলে? লোকটি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
আমি হেসে হেসে তাকে শিখিয়ে দিলাম নির্বাণ প্রার্থনা বড় করে বলবেন। আর অন্য
প্রার্থনা মনে মনে করুন। বন ভন্তে অন্য প্রার্থনা পছন্দ করেন না। তারপর বন ভন্তে
হীন প্রার্থনা সম্বন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা করে বলেন-কেহ পরীক্ষায় পাশ করার জন্য, কেহ ভোটে
জয়ী হবার জন্য, কেহ বড় লোক হবার জন্য আর কেহ যে কোন একটির জন্য প্রার্থনায় বসে।
এ পৃথিবীতে মনুষ্যরা টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, ধন-সম্পত্তি,
স্ত্রী-পুত্র, মানযশ-স্বাস্থ্য, পদ-রাজ্য এমনকি আপন সমৃদ্ধির জন্য নানাবিধ
প্রার্থনা করে থাকে। এইগুলি হল হীন প্রার্থনা। কেবল একটি প্রার্থনা করা উচিৎ। যে
প্রার্থনায় সর্ব দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করা যায়। তা হল নির্বাণ প্রার্থনা। দেশনা
শেষে আমি বনভন্তের নিকট প্রার্থনা করলাম-ভন্তে, আপনার দেশনা খুবই সংক্ষেপ। আরো
বিশদ ভাবে চাকমা ভাষায়। ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলে উপাসকেরা সহজে বুঝতে পারবে-এ
প্রার্থনাটি করছি। ভন্তে বললেন-বেশীক্ষণ দেশনা করলে আমার শক্তি থাকেনা একবেলা
অল্পাহার করে আর কত পারব? তুমি তাকে বুঝিয়ে বল। আমি তাকে প্রার্থনা সম্বন্ধে
বুঝালে তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না। তারপর শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে
বল্লাম-দেখুন, আপনি থাকতে আমার কথা শুনবে কেন? একটু পরে ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে
পারমার্থিক ভাবে প্রার্থনা সম্বন্ধে গভীর তথ্যপূর্ণ দেশনা করলেন। ঘটনাচক্রে আর
একদিন সেই ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা হয়। উৎফুল্ল চিত্তে তিনি বললেন- এই আমার
বৃদ্ধ মাতা, স্ত্রী, পুত্রকন্যা সবাই আপাততঃ ভাল আছে। তৎপর ভন্তেকে জিজ্ঞাসা
করলাম। ভন্তে, তাঁর প্রার্থনা হাতে হাতে ফল পেয়েছে। ভন্তে আমাকে বলেন-এগুলি
সত্যের প্রভাবে ফল হয়ে থাকে। নির্বাণ প্রার্থনাই সঠিক প্রার্থনা।
ধন্জন সব কিছু অনিত্যই ভবে।
প্রার্থনাই সঠিক তবে তাহা কর
সবে।।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ
একদিন বন বিহারে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার আসলেন।
বন ভন্তের সাথে বহু আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ
সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। বন ভন্তে তাঁর বক্তব্যে জবাবে বলেন-এগুলি হল
হীন ব্যক্তি ও সাধারণ লোকের জন্য ব্যবস্থা মাত্র। যাঁরা উত্তম ও অসাধারণ ব্যক্তি
তারা এগুলির বাইরে থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে থাকেন। এই সংসারে পুনঃ পুনঃ জন্ম
গ্রহণ করা দুঃখজনক। দুঃখ কি জানেন? জন্ম গ্রহণ করা দুঃখ, জন্ম গ্রহণে নানা
ব্যাধিতে ভোগে, এমনকি মারা পর্যন্ত যায়। বৃদ্ধ হলে দুঃখ, প্রিয় বিয়োগে দুঃখ,
আহার অন্বেষণে দুঃখ এবং মৃত্যু দুঃখ। দেখুন জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের কত যে
দুঃখ মৃত্যুর পর আবার জন্ম গ্রহণ করতে হয়। মনুষ্য জন্ম হলে ভাল কথা। নানাবিধ
প্রাণী হয়ে জন্ম নিলে দুঃখের সীমা থাকেনা জন্ম হলে বার বার দুঃখ আর কত সহ্য হয়?
তা হলে দুঃখের পরিত্রাণ কি? দুঃখের পরিত্রাণ হল নির্বাণ। নির্বাণই প্রকৃত জন্ম
নিয়ন্ত্রণ। নির্বাণ প্রাপ্ত হলে বার বার জন্ম হবেনা। অফিসার মহোদয় বনভন্তের জন্ম
নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে সামান্য মাত্র বুঝে সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
নির্বাণ
লাভ হইবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ।
জন্ম
লভিয়া না কর দুঃখ আমন্ত্রণ।।
সংগ্রাম
একদিন জনৈক সমবায় অফিসার বন ভন্তের নিকট এসে নানাবিধ
প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। বন ভন্তে উত্তর দিতে কার্পণ্য করলেন না। আমি মনে মনে
লোকটিকে ধন্যবাদ দিলাম। কারণ তাঁর প্রশ্নের মধ্যে আমারও অনেক প্রশ্ন ছিল। লোকটি
মনে হয় পন্ডিত। প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু একটা
মুখ্য প্রশ্নে সন্তুষ্ট হননি। সে প্রশ্ন হল, সৃষ্টিকর্তা আছে কি নাই? বন ভন্তে
উপমা দিয়ে বলেন-ধরুন, আপনার শরীরে হঠাৎ আগুন লেগে গেল এখন আগুন নিভাবেননা কি কে
দিল? কি জন্য দিল? নাকি কখন দিল খোঁজ খবর নিবেন? ভন্তে আগে আগুন নিভাতে হবে। ঠিক
সে রকম, আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজেকে জানলে অপরকে জানতে পারা যায়। আত্মশুদ্ধি
হলে সৃষ্টিকর্তাকে দেখা যায়। সৃষ্টিকর্তা কে জানেন? আমাদের মতে সৃষ্টিকর্তা
অবিদ্যা ও তৃষ্ণা জন্মগ্রহণ করায়। যে কোন প্রাণীকে সৃষ্টি করে অবিদ্যা ও তৃষ্ণা।
মানবগণ সৃষ্টি করে যাবতীয় খাদ্য ভোজ্য, আসবাবপত্র ব্যবহার্য বস্তু সমূহ। মানুষই
এসব বস্তুর। সৃষ্টিকর্তা ও ঈশ্বর। আপনি যে সৃষ্টিকর্তার কথা বার বার বলছেন, তা হল
শুধু মুখে। আমাদের মতে ব্যক্তি বিশেষের কোন সৃষ্টিকর্তা নাই। যে অবিদ্যা তৃষ্ণা
আমাদের পুনঃ পুনঃ দুঃখ প্রদান করে থাকে তার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করে থাকি।
অবিদ্যা, কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা সত্ত্বদিগকে জন্ম-জন্মন্তেরে নানা
দুঃখ যন্ত্রণা প্রদান করে বলে তার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করে থাকি। সুতরাং
অবিদ্যা, কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা সত্ত্বাদিগকে জন্ম-জন্মন্তেরে নানা দুঃখ
যন্ত্রণা প্রদান করে বলে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা একান্ত কর্তব্য।
সংগ্রামী
হও সবে নির্বাণ লাগিয়া
বিদর্শনে
রত হও নিশীথে জাগিয়া।।
যথার্থ দর্শন
তবলছড়ি বাজারের পরলোকগত ডাঃ আশুতোষ মিশ্র (বৃদ্ধ
ব্রাহ্মণ); ভদ্রলোক আমার সমবয়সী না হলেও আমার সাথে বেশ হৃদ্যতা ছিল। তিনি কয়েক
বার আমাকে বলেছেন আপনি বন বিহারে গেলে আমাকেও সংগে নিবেন। কিন্তু আমি যখন যেতাম
তখন তিনি ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। হঠাৎ আর একদিন বলেন- এইবার আপনার সাথে যে
কোন সময় যাব। বন ভন্তের দর্শন কোন দিন পাইনি। যথাসময়ে তাকে নিয়ে বন বিহারের
উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাজ ঘাটে হাত ধরে নৌকা পার করালাম। বুদ্ধ বন্দনার পর ভন্তেকে
বন্দনা করে নিয়ে যত্ন সহকারে তার জন্য একটি পাটি বিছায়ে দিয়ে তাঁকে বসার জন্য
অনুরোধ করলাম। তিনি আমাকে বললেন-এখন বসবোনা আমি আগে বন ভন্তেকে ভাল করে দেখি।
বনভন্তেও তাকে বসার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি ভন্তের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভাল করে
নিরীক্ষণ করে বললেনবহুদিন পর্যন্ত আপনার নাম শুনেছি, আজকে ভাল করে দেখছি। বন ভন্তে
আমাকে লক্ষ্য করে বলেন- “ভগবান বুদ্ধকেও এই রকম এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ
নিরীক্ষণ করেছিলেন। বুদ্ধের বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণ ও আশী প্রকার অনুব্যঞ্জন
লক্ষণ নিয়ে অতুলনীয় তার দেহ।” সেই ব্রাহ্মণকে বুদ্ধ বললেন-বুদ্ধ দর্শন হয়েছ ত।
ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে বলেন- হ্যা, ভন্তে আমার চোক সার্থক হয়েছে। শাস্ত্রে যা আছে তা
দেখলাম। বুদ্ধ বলেন-“তাহলে তুমি কিছুই দেখনি, মিথ্যা বলছ।” ব্রাহ্মণ বলেন-“সত্যই
আমি বুদ্ধকে দেখেছি।” তখন বুদ্ধ আবার বলেন-“বুদ্ধ অর্থ কি?” ব্রাহ্মণ একটু চিন্তা
করে বলেন- বুদ্ধ অর্থ জ্ঞান। বুদ্ধ বললেন- তা হলে জ্ঞানকে তুমি দেখেছ? বুদ্ধ এ
উক্তিটি করার সাথে সাথেই ব্রাহ্মণ অর্হত্ব ফল লাভ করলেন। অতঃপর বন ভন্তে বললেনআমার
মধ্যে বুদ্ধের কোন লক্ষণই নেই। আমাকে দেখে কি লাভ? “জ্ঞান দর্শন করাই যথার্থ
দর্শন” ইহা বলার পর ডাক্তার বাবু আমার পাশে বসে পড়লেন। আসার সময় জিজ্ঞাসা করলাম-
“ডাক্তার দাদা, কি বুঝলেন?” তিনি শুধু বললেন- “বন ভন্তে গভীর জ্ঞানের অধিকারী।
কিসে সুখ কিসে
দুঃখ?
১। যত আমার বলা হয় ততই দুঃখ।
২। পরের জিনিষ নিজের বলায় দুঃখ।
৩। সব পরের বলতে পারলে সুখ।
৪। আমার কিছুই নাই বলে সুখ।
৫। অজ্ঞানী সব সময় বলে আমার আছে।
৬। জ্ঞানী বলে আমার কিছুই নাই।
৭। পরের জিনিষ বলে দুঃখ নাই।
৮। কিন্তু নিজের বলে দুঃখ।
দুঃখ দুঃখ মহা দুঃখ দুঃখের কারণ।
দুঃখের নিরারোধ সত্য দুঃখের বারণ।।
বনভন্তে-ডি সি
একদিন বনভন্তে উপাসক উপাসিকাদের বিরাট সভায় দেশনায় রত এমন সময়
এক উপাসক ভন্তের সাথে কথা বলার অবকাশ পাচ্ছিলনা। হঠাৎ দেশনার ফাঁকে ঐ উপাসক বললেন-ভন্তে
আমার বাবা মারা গেছেন, কোথায় জন্ম গ্রহণ করেছেন একটু জানতে চাই। বনভন্তে আমাকে
লক্ষ্য করে বললেন-দেখত ডি,সি’র
কাছে কেরানীর কাজ নিয়ে আসছে। আমি বললাম-ভন্তে, আমি কি? ভন্তে বললেন-তুমি পিয়ন।
কেরানী কি রকম জান? কেরানী হল চূতি উৎপত্তি সম্বন্ধে জানে ও দেখে। যারা প্রথম
ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান ও চতুর্থ ধ্যানে বুৎপত্তি লাভ করেন, তাঁরা
সত্বগণের চ্যুতি উৎপত্তি স্বয়ং জ্ঞাত হন। এগুলি হল কেরানীর কাজ। আমি ডি, সি,
নির্বাণের কথা বলব। চতুর্থ ধ্যান লাভীরা চ্যুতি উৎপত্তির সংগে সংগে জানতে পারেন বা
দেখেন কিন্তু দেরী হলে সহজে বলতে পারেন না। যেমন ধর, এই বিহার হতে একজন লোক
বাজারের দিকে চলে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে গেলে হয়ত নদীর ঘাটে নতুবা রাস্তায় দেখা
পাবে। যদি সকাল বেলা চলে যায়? রাঙ্গামাটি হতে খুঁজে বের করা অনেক সময় ও
কষ্টসাধ্য।অনেক সময় দেখা যায় ডিসিও দয়া করে কারো কেরানীর কাজ করে দেন। তেমনি বন
ভন্তেও উপাসকের বাবার গতি সম্বন্ধে পরোক্ষ ভাবে বলে দিলেন। আমার মনে হয় পরোক্ষভাবে
বলাতে লোকটি ভাল করে বুঝতে পারেন নি। তারপর বন ভন্তে ডিসির দায়িত্ব ও কর্তব্য
সম্বন্ধে বললেন যেমন প্রত্যেক মুক্তিকামী ব্যক্তি মুক্ত কিভাবে হয় এবং কোন পথে
গেলে মুক্ত হওয়া যায় তার বিশদ ব্যাখ্যা করলেন। জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ পদ হল ডিসি।
পারমার্থিক ভাবে প্রত্যেকের লক্ষ্য ও শেষ গন্তব্য হল নির্বাণ। সে জন্য বন ভন্তে
ডিসি।
ডিসি
হয়ে বড় হও পিয়নে থাকনা।
ছোট
হলে বড় দুঃখ জীবন বাঁচেনা।
বন ভন্তের দৃষ্টি?
দৃষ্টি বলতে সম্যক দৃষ্টিকে বুঝায় কিন্তু সাধারণ চোখের দৃষ্টি এবং
জ্ঞানের দৃষ্টির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। যার দৃষ্টি যেমন তেমন করে দেখে বা কলম
দিয়ে লেখে। রঙিন চশমা পরিধানকারীর রঙিনই দৃষ্টি হবে। জনডিস রোগীরা স্বাভাবিক না
দেখে সকল বস্তু হলুদ বর্ণ দেখে। একজন ছোট শিশু টাকাকে তার খাওয়ার বিনিময় বা
খেলনার বিনিময় হিসেবে দেখে। একজন সাধারণ লোকের নিকট টাকা তার সংসার চালানোর উপকরণ
মাত্র। কিন্তু রাষ্ট্র প্রধান টাকাকে আন্তর্জাতিকভাবে দেখে থাকেন। সুতরাং দেখা
যায় ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি ও জ্ঞানের পরিধি। ব্রহ্মজাল সূত্রে বর্ণিত ৬২ প্রকার
মিথ্যা দৃষ্টি পরিহার করে সম্যক দৃষ্টি উৎপন্ন হলে লোকোত্তরে উন্নীত হওয়া যায়।
এখানে বন ভন্তে দৃষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে যা ব্যক্ত করেছেন তা লিপিবদ্ধ করা
হল।
(১) শ্রদ্ধেয় বনভন্তে দিঘীনালা
এবং লংগদুর তিনটিলায় থাকতে পর্দা ব্যবহার করতেন। তিনটিলায় আমি নিজেও দেখেছি তার
কামড়ায় উপাসক ব্যতীত উপাসিকারা বাহিরে অবস্থান করে বন্দনা এবং তার দেশনা শুনতেন।
এখন অনেকে প্রশ্ন করেন বন ভন্তে পর্দা ব্যবহার করেন না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বন
ভন্তে বলেন-“আগে
আমি পিচ্ছিল জায়গায় ছিলাম। সবসময় পতনের আশংকা ছিল। কিন্তু এখন শক্ত এবং নিরাপদ
জায়গায় আছি। উপমায় আরো বলেন- “খারাপ
রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালানো বিপদ। কোন সময় গাড়ী পড়ে যায় ঠিক নাই। এখন তিনি
খারাপ রাস্তা পার হয়ে বিপদ মুক্ত রাস্তায় আছেন, সুতরাং এখন ও ভবিষ্যতে তার পতনের
কোন সম্ভাবনা নেই। তিনি আরো পরিস্কার ভাবে বলেন-তার দৃষ্টিতে শুধু নারী কেন পুরুষও
নেই। বর্তমানে তিনি নারী পুরুষকে আগুন, পানি, মটি ও বায়ু বা চতুর্মহাভূত হিসাবে
দেখে থাকেন। .
(২) একদিন দেশনায় বলেন-এই পৃথিবীতে তিনি রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত,
পন্ডিত-মূর্খ, ভিক্ষু-শ্রমণ সকলকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় দেখেন। এ কথার প্রকৃত
অর্থ হল শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞারূপ বস্ত্রহীনতা।
(৩) আর একবার ভোটের সময় বন ভন্তে দেশনায় বলেন-সকল শ্রেণীর লোকদেরকে
তিনি শিশুর মত দেখেন। শিশুরা ধূলাবালি অথবা নানা ধরনের খেলনা নিয়ে খেলায় রত
থাকে। মধ্যে মধ্যে মারামারি ও নানা বিবাদে লিপ্ত হয়। এর অর্থ কামভোগী গৃহীরা
বিষয় সম্পত্তি নিয়ে মত্ত থাকে এবং কলহ বিবাদে রত থাকে।
(৪) চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে দেশনা করার সময় একদিন বন ভন্তে বলেন,
অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যা দেখা যায়, খালি চোখে তা দেখা যায় না, তেমনি তিনিও
আমাদের অসংখ্য দুঃখরাশি দেখতে পান। তিনি আরও বলেন-একশত ভাগের এক ভাগ সুখ ভোগ করে
আমরা হাসিতে খুশিতে জীবন কাটাই কিন্তু একশত ভাগের নিরানব্বই ভাগ দুঃখের বোঝা
কোথায় আছে জানিনা। তার দৃষ্টিতে আমরা শুধু দুঃখের বোঝা বহন করেই চলেছি।
(৫) দেশনা প্রসঙ্গে একদিন বন ভন্তে বলেন-কোন এক গ্রামে একজন লোক
এম, এ পাশ করে গ্রামের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিতদিগকে যে ভাবে দর্শন করে থাকে, সেরূপ
তিনিও আমাদেরকে দর্শন করে থাকেন।
(৬) মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বৃষ্টিতে ভিজে এবং কড়া রোদ সহ্য করে কাঠুরিয়া
কাঠ কেটে বাজারে বিক্রির জন্য রাস্তা দিয়ে গান গেয়ে গেয়ে কাঠ নিয়ে যায়। তখন
ডি,সি কাঠুরিয়াকে যে ভাবে দেখে থাকেন, সেরূপ ভন্তে ও কামভোগীদেরকে ডিসির মত দেখে
থাকেন।
উপরোক্ত ছয়টি উপমামূলক বনভন্তের মুখঃনিসৃত বাণী লিপিবদ্ধ করে
উপাসক উপাসিকাদের নিকট ব্যক্ত করলাম।
স্কন্ধের
উদয় ব্যয়ে স্ত্রী পুরুষ নাই।
ভয়
স্কন্ধের বিলীন হয় নির্বাণেতে যাই।
আগন্তক ও বন ভন্তে
মহান সাধক শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তের আবাস পূত রাজবন বিহার দেশের একটি অন্যতম আদর্শ বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
এখানে প্রতিবছর মহা সমারোহে কঠির চীবর উদযাপিত হয়। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে
সূতা কাটা, বস্ত্র বয়ন ও সেলাই শেষে চীবর দান কার্য সম্পাদন এ দানোৎসবের মূল
বৈশিষ্ট্য যা বুদ্ধকালীন সময়ের এক সুপ্রাচীন পদ্ধতি। বর্তমান বিশ্বে কোথাও এধরনের
দানোৎসব অনুষ্ঠিত হয় কিনা জানা নেই। এ উপলক্ষ্যে অগণিত বৌদ্ধ নর-নারীর সমাগম হয়।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বহু দর্শনার্থীও এ দানোৎসব দেখতে আসেন।
সেই রাজ বন বিহারে এক কঠিন চীবর দানোৎসবের
জনাকীর্ণ সন্ধ্যা। তখন দেশনালয় লোকে লোকারণ্য। শান্ত সমাহিত গীরভাবে শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তে ধর্মাসনে উপবিষ্ট। সে মুহূর্তে জন পনের ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা এসে উপস্থিত।
আমি লোকের ভীড় ঠেলে তাঁদের এক প্রান্তে বসিয়ে দিলাম। তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল
তারা ঢাকা থেকে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে জনৈক ভদ্রলোক কোরান, বাইবেল ও বেদ সম্বন্ধে
যথেষ্ট চর্চা করেছেন। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে তেমন কিছু জানেন না বলে প্রকাশ
করলেন। তিনি অনুসন্ধিৎসু হয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সঙ্গে আলাপ করার অভিপ্রায়
জানালেন। আমি তার অভিপ্রায় সম্বন্ধে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে অবহিত করলাম। শ্রদ্ধেয়
ভন্তের সম্মতিক্রমে উভয়ের মধ্যে আলাপকালীন ভদ্রলোকের প্রশ্ন ও শ্রদ্ধেয় ভন্তের
উত্তর গুলো প্রত্যেকের পক্ষে জ্ঞাতব্য বিষয় মনে করে এ লেখার অবতারণা।
ভদ্রলোকের প্রশ্নঃ রাম বনে যাবার সময় সীতাকে
সঙ্গে নিয়েছিলেন কিন্তু সিদ্ধার্থ বনে যাবার সময় গোপাকে সঙ্গে নিলেন না কেন?
বন ভন্তেঃ রাম গিয়েছিলেন বনবাসে, আর
সিদ্ধার্থ গিয়েছিলেন ধ্যান-সাধনা। করার জন্য। গাটুটি (এখানে নারী লোককে গাইটি বা বোঝা
বলা হয়েছে) কি জন্যে নেবেন?
ভদ্রলোকের প্রশ্নঃ গাটুটি কি?
বন ভন্তেঃ এইতো আপনারা গাট্টটি নিয়ে এসেছেন।
তিনি ভদ্র মহিলাদের দিকে দৃষ্টি ফিরায়ে বললেন-তারা আমাদের কথাগুলো না শুনে শুধু
গল্প করছেন তখন গাটির অর্থ বুঝতে পেরে ভদ্র মহিলারা বিরক্তি বোধ করে উঠে পড়ার
জন্য সঙ্গীদের তাগিদ দিলেন। কিন্তু ভদ্রলোকেরা ভন্তের সাথে আলাপ করার জন্য আগ্রহী
হওয়ায় মহিলা সাথীদেরকে বিহার এলাকায় ঘুরে দেখার জন্য বললেন।
ভদ্রলোকের প্রশ্নঃ সিদ্ধার্থ বনে গিয়ে কি
ধ্যান করেছিলেন?
বন ভন্তেঃ কায় বিবেক, চিত্ত বিবেক ও উপধি
বিবেকই ছিল তাঁর ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য।
ভদ্রলোকের প্রশ্ন ও এগুলোর অর্থ কি?
বন ভন্তেঃ কায় বিবেক হলো জনসঙ্গ বর্জন
অর্থাৎ লোকালয় বর্জিত স্থানে ধ্যান মগ্ন হওয়া, চিত্ত বিবেক হচ্ছে মানুষের চিত্ত
সদা চঞ্চল ও অস্থির। স্বীয় অস্থির চিত্তকে অচঞ্চল ও স্থির করে ধ্যানে মনোনিবেশ
করা। উপধি বিবেক হচ্ছে চিত্তকে বিভিন্ন ক্লেশ হতে মুক্ত করে নির্বাণের মধ্যে
প্রবিষ্ট করা। এগুলো তত্ত্ব মূলক বিষয়। ভদ্রলোকঃ আচ্ছা নারী জাতি মুক্ত হতে পারে
কিনা? সিদ্ধার্থ গোপাকে মুক্তি দিলেন না কেন?
বন ভন্তেঃ ধরুন, আপনার নিকট এ ভদ্রলোক কিছু
টাকা পাবেন। আপনি তাঁকে হাতে হাতে না দিয়ে অপর জন মারফৎ টাকাগুলো দিলেন। তিনি
টাকাগুলো পাবেন কি?
ভদ্রলোকঃ হ্যা পাবেন।
বন ভন্তেঃ সেই সিদ্ধার্থ ও বুদ্ধ হয়ে তাঁর
বিমাতা গৌতমীকে দীক্ষা দিয়ে মুক্তি বা অহৎ করেছিলেন। গোপাও গৌতমী হতে দীক্ষা
নিয়ে অহৎ হয়েছিলেন। বুদ্ধের সময়ে নারীও মুক্ত বা অর্হৎ হতে পারতো কিন্তু এখন
সেরূপ উপযুক্ত পরিবেশ নেই।
ভদ্রলোকঃ হযরত মোহাম্মদ আল্লাহর দূত বা
বন্ধু, যীশু গড এর প্রেরিত পুত্র এবং যুগে যুদে ঈশ্বরের প্রেরিত অবতার রূপে
পৃথিবীতে এসে সৃষ্টিকর্তার ধর্ম প্রচার করেন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ কে?
বন ভন্তেঃ গৌতম বুদ্ধ কারো দূতও নহেন, অবতারও
নহেন। তিনি হলেন নির্বাণের আবিস্কারক। তিনি স্বয়ং মুক্ত হয়েছেন। তাই অপরকেও
মুক্ত করতে পারেন। তিনি মুক্তির পথ প্রদর্শক।
ভদ্রলোকঃ আপনাদের মতে সৃষ্টিকর্তা আছে কি নেই
তা জানতে চাই?
বন ভন্তেঃ আছে বললেও ভুল হবে এবং নেই বললেও
ভুল হবে।
ভদ্রলোক ? তা কি রকম?
বন ভন্তেঃ অবিদ্যা-তৃষ্ণা প্রাণীদেরকে সৃষ্টি
করায়। মানুষেরাই নানাবিধ বস্তুর সৃষ্টিকর্তা।
ভদ্রলোকঃ তা কি রকম?
বন ভন্তেঃ সংক্ষেপে বলতে গেলে-অবিদ্যা অর্থ
অজ্ঞানতা। তৃষ্ণা অর্থ কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা। আগে নিজেকে নিজে
দেখতে হবে। যেমন প্রথমে ইন্দ্রিয় সংযম, আত্ম দমন ও চিত্ত দমন করতে হবে। সংযমী ও দমিত
হলে জ্ঞানচক্ষু উৎপন্ন হয়। জ্ঞানচক্ষু দ্বারা ভাল-মন্দ, সম্বন্ধে বুঝতে পারা যায়
ও সত্য জ্ঞান উদয় হয়।
সত্য জ্ঞান উদয় অর্থে দুঃখে জ্ঞান, দুঃখের
কারণ সম্বন্ধে জ্ঞান, দুঃখ নিরোধে জ্ঞান ও দুঃখ-নিরোধ প্রতিপাদন জ্ঞান বা আর্য
অষ্টাঙ্গিক মার্গ জ্ঞানই সত্য জ্ঞান। জ্ঞান ও সত্য উদয় হলে অবিদ্যা-তৃষ্ণা ধ্বংস
হয়, অর্থাৎ আরো সত্য উদয় হয়।
ভদ্রলোকঃ তাহলে প্রত্যেকে কি জন্ম গ্রহণ
করবে?
বন ভন্তেঃ হ্যা, জন্ম বীজ থাকলে জন্ম হবে। আর
জন্মবীজ নষ্ট হলে জন্ম গ্রহণ বন্ধ হবে।
ভদ্রলোকঃ কে জন্ম গ্রহণ করায়?
বন ভন্তেঃ কর্মফল।
ভদ্রলোকঃ আপনাকে কে এই পৃথিবীতে পাঠালেন?
বন ভন্তেঃ আমার কর্মফল। কর্মফলে আপনাকেও পাঠিয়েছে। যেমন, পৃথিবীতে
যত প্রাণী আছে, সবাই আপন আপন কর্মফলে জন্ম গ্রহণ করেছে। চন্দ্র, সূর্য,
গ্রহনক্ষত্র ও আপন আপন কর্মফলে ঘুরছে। কর্মফল সত্ত্ব সমূহকে হীনত্বে ও মহত্বে
রূপান্তরিত করে।
ভদ্রলোকঃ মানুষ কি জন্তুতে পরিণত হয়?
বন ভন্তেঃ হ্যা, মৃত্যুর পর দেহ পড়ে থাকে। চিত্ত রূপান্তরিত হয়ে
অন্য দেহ ধারণ করে।
ভদ্রলোকঃ এগুলোর সমাধান কি?
বন ভন্তেঃ অবিদ্যা তৃষ্ণার নিরোধ হলে নির্বাণ হয়। যেমন তেলের
অভাবে দীপ নির্বাপিত হয় এক্ষেত্রে তা উপমা করা যায়।
ভদ্রলোকঃ দেবতা ব্রহ্মার পুনঃ জন্ম হয় কিনা?
বন ভন্তেঃ নির্বাণ না হওয়া পর্যন্ত পুনঃ জন্ম থেকে কেহই রক্ষা
পায় না।
এভাবে কথোপকথনের সময় সঙ্গী মহিলারা যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু
করলেন। তখন বন ভন্তে বললেন-এইতো আপনাদের গাটটি চলে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে
পড়েছেন। ভদ্রলোক বললেন-সত্যি আপনি যে তাদেরকে গাটটি বলেছেন সেকথা ঠিক। আগে জানলে
এই গাটটিগুলো নিয়ে আসতাম না। ভদ্রলোকের আরো বহু জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্য ছিল,
কিন্তু সঙ্গীনীদের পীড়াপীড়িতে তারা শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক
সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় নিলেন।
সূতর্কে
বাড়ায় জ্ঞান, কুতর্কে অজ্ঞান।
জ্ঞান
আর ধ্যান দিয়ে পাবে বুদ্ধ জ্ঞান।।

সদ্ধর্ম পুকুর
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে দেশনা প্রসঙ্গে আমাদের প্রতি লক্ষ্য
করে বলেন- তোমরা প্রত্যহ পুকুরে বা নদীতে স্নান করে থাকো তাতে শরীরের ময়লা
পরিস্কার হয়। আসল হল চিত্তের ময়লা। চিত্তের ময়লা দূর করতে হলে সেই প্রকার
পুকুরও লাগবে। সেই সদ্ধর্ম পুকুর হল নির্বাণ। আবার সদ্ধর্ম পুকুরের নাম কেউ কেউ শোনেও
নাই। আবার কেউ কেউ নাম শুনেছ। কেউ কেউ কোথায় আছে জানেনা, কেউ কেউ বই পুস্তকে বা লোকের
মুখে শুনেছে। যেমন সাত সাগর তের নদী পার হয়ে টেমস নদী পাড়ে লন্ডন শহর আছে, তা
জানে কিন্তু সেখানে যায় নি। যারা লন্ডনে গিয়েছে তাদের লন্ডনের অভিজ্ঞতা আছে। সে
রকম কেউ ত্রিপটক অধ্যয়ন করে নির্বাণের কথা বলে। আর কেউ নির্বাণ অধিগত করে
প্রত্যক্ষ প্রমাণাদি প্রকাশ করেন। আর এক ধরনের লোক আছে মধ্যে মধ্যে পুকুর পাড়ে
আসে এবং আবার চলে যায়। আর কেউ পুকুর পাড়ে ঘুরাফেরা করে। যেমন তোমরা নির্বাণ
পুকুর পাড়ে ঘুরাফেরা করছ। কিছু সংখ্যক লোক ঘাটে বসে পানি নাড়া চাড়া করছে। কেউ
কেউ মধ্যে মধ্যে পুকুরে নেমে স্নান করছে। খুব কম সংখ্যক লোকে নির্বাণ পুকরে নিত্য
স্নান করে। সদ্ধর্ম পুকুর বা নির্বাণ পুকুরে যারা নিত্য স্নান করে তাদের চিত্তের
ময়লা দুরীভূত হয় পুনঃ পুনঃ জন্ম গ্রহণ করেনা, পঞ্চ মারের দৃষ্টিশক্তির বাহিরে
চলে যায়। অর্থাৎ নাগাল পায় না। এ সদ্ধর্ম পুকুর বা নির্বাণ কোথায়? তার একটা
জায়গা নয়। শুধু যাদের জ্ঞানচক্ষু বা সত্য সমুহ অধিগত হবে তারাই চিত্তের দ্বারাই
উপলব্ধি করতে পারবেন। দেশনা শেষে বললেন- আমি ত নিত্য স্নান করি। আমার কোন প্রকার
দুঃখ, ক্ষুধা, দুর্বলতা, আলস্য নেই।
চির
শান্ত হও সবে সদ্ধর্ম পুকুরে।
স্নানে
পরিস্কার কর চিত্তের মুকুলে।।
নির্বাণ যাত্রী
বন ভন্তে দেশনা প্রসঙ্গে বলেন-গয়া যেতে হলে অনেক টাকার
প্রয়োজন। নির্বাণ লাভ করতে হলেও টাকার প্রয়োজন। সে টাকা কি রকম জান? অল্প শ্রদ্ধা
নয়, মধ্যম শ্রদ্ধাও নয় বিপুল শ্রদ্ধার প্রয়োজন। বিপূল শ্রদ্ধা না থাকলে কেহ
নির্বাণ যেতে পারে না। আবার যেতে হলে সঙ্গী সাথীর প্রয়োজন। ভগবান বুদ্ধের সময়ে
প্রায় সকলে নির্বাণ যাত্রী ছিল অথবা বুদ্ধ স্বয়ং নির্বাণ যাত্রীদেরকে মারের
রাজ্য অতিক্রম করে দিতেন। বর্তমানে সে রকম যাত্রী এবং বুদ্ধও উপস্থিত নেই। অর্থাৎ
উপযুক্ত পরিবেশ নেই। নির্বাণ যাত্রীদের কি করা কর্তব্য। অনেকে নির্বাণ যাত্রী
হওয়ার আশা পোষণ করে কিন্তু সাধ্য নেই। কেউ কেউ ত্রিপিটক মুখস্থ করে নির্বাণের
বর্ণনা করেন। কিন্তু সত্যিকারের যাত্রী নয়। কেউ কেউ আসবাদি নানা উপকরণ নিয়ে
নির্বাণ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। যেমন তোমরা সব সময় যাওয়ার জন্য
উদ্গ্রীব কিন্তু সাহস পাচ্ছনা(নির্বাণের পথে না চললে নির্বাণে কি যাওয়া যায়?
নানা পথে চলে ঘুরাফেরা করলে তার জন্য নির্বাণ যাওয়া দুঃসাধ্য। নির্বাণ যাওয়ার
একমাত্র রাস্তা হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। সে রাস্তা দিয়ে চললে রাস্তায় কতগুলি বোঝা
ফেলে যেতে হবে। সংক্ষেপে বোঝাগুলি লোত, দ্বেষ,মোহ, মিথ্য দৃষ্টি, সৎকায় দৃষ্টি,
শীলব্রত পরমাশ, তন্দ্রা, আলস্য, অবিদ্যা-তৃষ্ণা, মান ইত্যাদি। সেই রাস্তা দিয়ে
যারা চার ভাগের একভাগ অতিক্রম করে তাদের মিথ্যাদৃষ্টি, সন্দেহ ও শীলব্রত পরমাশ খসে
পড়ে যায়। অন্যান্য বোঝা চার ভাগের তিন ভাগ থেকে যায়। তাদেরকে শ্রোতাপত্তি বলে।
তারা সাত জন্মের অধিক জন্ম গ্রহণ করেনা। দুর্বার আগ্রহ ও শক্তি নিয়ে যারা আরও
শক্তি সঞ্চয় করে আরও অগ্রসর হন তারা অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করেন। অর্থাৎ ২
চারভাগের দুই ভাগ রাস্তায় অন্যান্য বোঝাগুলো অর্ধেক খসে হালকা হয়। তারা একবারের
অধিক জন্মগ্রহণ করেন না। তাঁদেরকে সকৃদাগামী বলে। তারপর যারা আরও অগ্রসর হয়ে চার
ভাগের তিন ভাগ অতিক্রম করেন তাদের বোঝামাত্র একভাগ থেকে যায়। তাঁদেরকে অনাগামী
বলে। তাঁরা শুদ্বাবাস ব্রহ্মলোকে পরিনির্বাপিত হন। আর যারা শেষ প্রান্তে পৌঁছেন
তাদের সম্পূর্ণ বোঝা খসে পড়ে। বোঝা শূন্য বা নির্বাণ যাত্রী হয়ে আর জন্ম গ্রহণ
করবেন না।
পরিবেশ
গড় তুমি যাত্রার প্রাক্কালে।
পাইবে
পরম সুখ তৃষ্ণা মুক্ত হলে।।
সাধারণ-অসাধারণ
একদিন বন বিহারে দেশনালয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে ধ্যানস্থ
অবস্থায় আছেন। অনেক উপাসক-উপাসিকা বন্দনা করে বসে অপেক্ষমান। দুই জন ভ্দ্রলোক বন
ভন্তের মুখনিঃসৃত বাণী শুনার জন্য আমাকে বললেন। আমি ভন্তের প্রতি প্রার্থনা করার
পর আদর্শ গৃহী ধর্ম সম্বন্ধে দেশনা করলেন। ভদ্রলোকদ্বয় শুধু একটা কথাই বললেন-প্রয়োজনে
প্রাণী বধ করা যায় কিনা? তারপর বন ভন্তে তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেনএই প্রাণী
খাও, এই প্রাণী খাইওনা। এই প্রাণী মার ঐ প্রাণী মেরোনা। নিজ জাতিকে ভালবাস, অপর
জাতিকে ভিন্ন মনে কর একজনকে জান আপন, অন্যজনকে জান পর। হিংসাকারীকে হিংসা কর,
পাপীকে ঘৃণা কর, একজন আমাকে উদ্ধার করবে, এই আশায় বসে থাক। ভালকে মন্দ, মন্দকে
ভাল, সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, অনিত্যকে নিত্য, নিত্যকে অনিত্য। এ জীবন শেষ
হলে পরকাল নাই ইত্যাদি সাধারণ লোকের কথা। যেমন চোখ থাকতে অন্ধ এবং রোগ মুক্তির
জন্য ভূল ঔষধ খাওয়া একই ব্যাপার। সুতরাং ইহাই সাধারণ।
অতঃপর তিনি বললেন-এ পথিবীতে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত
স্বজাতি-ভিন্নজাতি, হিংসুক-পাপী দৃশ্য-অদৃশ্য প্রাণী, শত্রু-মিত্র, জ্ঞাতী-অজ্ঞাতী
সর্বজীবের প্রতি আত্মবৎ জানতে হবে। এ পৃথিবীতে যত কিছু আছে তন্মধ্যে আপন শরীরই
প্রধান। আপন শরীরের মত সকল কিছু আত্মভাব পোষণ করতে হবে। জাতিবাদ কি জান? জাতিবাদ
হল একটা আবরণ। আপনার চোখ দুইটা কাপড় দিয়ে বন্ধ করলে যেমন দেখতে পাবেন না,তেমনি
জাতিবাদও সেরূপ শুধু পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অসাধারণ। হওয়া যায়না। মনকে খুব উদার
করতে হবে। নীল আকাশের মত মুক্ত ও উদার হতে হবে। বাতাসের মত আশ্রয়হীন হতে হবে। এ
রকম বিভিন্নভাবে যুক্তি উপমা দিয়ে লােকোত্তর দেশনা করে অসাধারণ সম্বন্ধে বুঝিয়ে
দিলেন।
চিত্তের অনুকূলে
দেশনা
পরচিত্ত বিজনন সম্বন্ধে বন ভন্তে বলেন- এটা একটা আয়না
বিশেষ। সে আয়না কেমন জান? যেমন তোমার এক আয়না আছে। সে আয়নায় তোমার প্রয়োজনে
মুখ। দেখতে পার। সেরূপ পরচিত্ত বিজনন জ্ঞান ও অপরের চিত্তে কোথায় কি আছে তা
পরিস্কার ভাবে দেখা যায়। পরচিত্তকে দেখে, জেনে ও বুঝে দেশনা করলে শ্রোতার
মহাউপকার সাধিত হয়। যেমন সুদক্ষ চিকিৎসক রোগের উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ করে রোগ আরোগ্য
করেন, তেমন সুদেশক পরচিত্তের অনুকুলে দেশনা করে শ্রোতাদের মহাউপকার সাধিত করেন।
আন্দাজ বা অনুমানে ধর্ম দেশনা করলে ব্যর্থ শিকারীর মত ব্যর্থতার পরিচয় ছাড়া আর
কিছুই নয়। তিনি পর চিত্তের অনুকুলে দেশনা সম্পর্কে বলেন- এই হদের জল কেহ সারাজীবন
ব্যবহার করলে নিঃশেষ করতে পারবেনা। আমার জ্ঞান ভান্ডারও হদের জলতুল্য। আমি তোমাদের
নিকট উদাত্ত কণ্ঠে জানাই-তোমরা ক্ষমতা অনুযায়ী জ্ঞান পাত্র নিয়ে আস। আমি তোমাদের
জ্ঞান পাত্র অনুযায়ী পরিপুর্ণ করে দেবো। এক প্রসঙ্গে বলেন- আমার নিকট কেউ এসে
শুধু জ্ঞান জল পান করে চলে যায়। সংগে কিছু নিয়েও যায়। কেউ কেউ ছোট পাত্র, কেউ
মধ্যম পাত্র নিয়ে আসে। খুব কম সংখ্যক লোকই বড় পাত্র নিয়ে আসে। আমি তাদের
পাত্রের আয়তন বুঝে পরিপুর্ণ করে দিই।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে উপাসক উপাসিকাদের প্রতি প্রায় চিত্তের অনুকূলে
দেশনা করে থাকেন। তাঁর বহু দেশনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশনা আপনাদের নিকট
প্রকাশ কছি।
(১) আপনারা বোধ হয় কেউ কেউ জানেন বন বিহারে যাওয়ার সময় কয়েকটা
নিয়ম আছে। যেমন দানীয় সামগ্রী ঝুলাইয়া ঝুলাইয়া না নেওয়া, পায়ে স্পর্শ না
করা, কোন জিনিষ নেওয়ার আগে বিতর্ক না করা, যাওয়ার সময় অপলাপ না করা ইত্যাদি।
এগুলি স্বয়ং তিনি দেখে অনেক সময় সংগে সংগে বলে থাকেন। একদিন আমি আমার এক আত্মীয়
বাবু সাধন চন্দ্র বড়ুয়ার সাথে বন বিহারে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে আমার সঙ্গীকে
অন্য লোকের সাথে বৃথালাপ করতে বাধা দিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিও তাদের সাথে
বৃথালাপ রত হয়ে বন বিহারে উপস্থিত হই। বন ভন্তে প্রথমেই দেশনা করলেন-নির্বাণ লাভেচ্ছু
ব্যক্তির ক্ষেত্র বিশেষে চোখ থাকতে অন্ধের মত, মুখ থাকতে বোবার মত এবং কান থাকতে
বধিরের মত থাকতে হয়। না হয় সদ্ধর্ম হতে অনেক দূরে তাঁর অবস্থান। যেমন তােমাদের
হতে চন্দ্র সূর্য অনেক দূরে অবস্থিত ঠিক সেরকম তোমাদের হতে সদ্ধর্ম লাভও একই কথা।
বনের বানরকে মণি-মুক্তার হার দিলে তা ফেলে বেগুন নিয়ে সন্তুষ্ট হয়। তেমন মানুষ
হয়ে সদ্ধর্ম রূপ মণি-মুক্তা ফেলে নানা বিষয়ে রত থাকা একই ব্যাপার। এ ভাবে
ধর্মদেশনা করে আমার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন-তুমি কেন পথে বাজে আলাপে রত থাক? এ কথা
বলার সাথে সাথেই আমারকৃতকর্মের কথা স্মরণ পড়ল। অতঃপর বন ভন্তে আমার চিত্তের
অনুকূলে দেশনা করে উপস্থিত সকল উপাসক-উপাসিকার চিত্ত সম্বন্ধে প্রকাশ করলেন।
(২) নব বর্ষের ১লা বৈশাখের দিন। বন বিহারে যাওয়ার সময় নদী ঘাটে
জনৈক ভদ্রলোক আমার সঙ্গী হন। নদী পার হতে হতে রাজনৈতিক আলাপ করতে লাগলেন। আলাপের
এক পর্যায়ে হিংসাত্মক মনোভাবের কথাও জানালেন। আমি মনে মনে চিন্তা করছিলাম এখন
ভন্তে কি বলেন কি জানি? বন্দনাদির পর ভন্তে সে লোকের প্রতি লক্ষ্য করে
বললেন-হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান এবং সর্বজীবের প্রতি মৈত্রী ভাবাপন্ন হও।
সামান্য প্রাণীকেও আত্মবৎ জানিও। হিংসা পরিত্যাগ করে অহিংসার নীতি গ্রহণ কর তা হলে
ইহকাল-পরকাল পরম সুখে থাকবে। পরে দেখা গেল সে লোক ভন্তের অনুগত উপাসক হয়ে জীবনের
গতি পরিবর্তন করেছেন।
(৩) মিথ্যা মামলায় জড়িত এক যুবক বন ভন্তের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা
করল। বন ভন্তে বল, পৃথিবীতে কোথাও প্রকৃত আশ্রয় নেই। একমাত্র জ্ঞানের আশ্রয় ও
সত্যের আশ্রয়ই প্রকৃত আশ্রয়। জ্ঞান আর সত্য মানুষকে রক্ষা করে। ক্ষমাশীল হও।
যেমন এ পৃথিবী ক্ষমাশীল। কারো প্রতি প্রতিহিংসা নেই। পৃথিবীর মত ক্ষমাশীল হলে
শত্রু ও বিপদ তিরোহিত হবে। ভীত যুবক বন ভন্তের দেশনা শুনে নির্ভয়ে চলে বিপদ মুক্ত
হয়েছিল।
(৪) একদিন বন বিহার হতে আসার সময় গেইটে আমার
এক পরিচিত লোক ভন্তের নিকট আশীষের জন্য যাচ্ছিল। আমি আবার তার সঙ্গে গেলাম। লোকটি
পাকা কাজের জন্য বালি সরবরাহ করে, বল-ভন্তে, আমাকে আশির্বাদ করুন আমি যেন সুখে
শান্তিতে থাকতে পারি। ভন্তে বলেন-আমার দুটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন কর। প্রথমঃ
মিথ্যা কথা বলো না। দ্বিতীয়ঃ চুরি করোনা। সে বলল, ভন্তে, আমি চুরি করিনা। ভন্তে
আবার বললেন-অনেক প্রকার চুরি আছে। আমার এ দুটো উপদেশ পালন করলে তোমার ইহকাল, পরকাল
সুখে শান্তিতে কাটবে। তবুও সে লোক পুনর্বার আশির্বাদ চাইলে, ভন্তেও বললেন-আগে আমার
দুটি কথা রক্ষা কর, পরে আশির্বাদ।
(৫) একদিন দেশনালয়ে এক দম্পত্তি আসলেন। বন
ভন্তে জিজ্ঞাসা করলেনআপনারা কোথা হতে এসেছেন?
ভদ্রলোকঃ ঢাকা হতে এসেছি।
বন ভন্তেঃ ঢাকার লোক মদ খায়। আচ্ছা, ঢাকার লোক
বেশী মদ খায় তা কি ঠিক?
ভদ্রলোকঃ কেউ কেউ খায়।
বন ভন্তেঃ কি ভাবে খায়?
ভদ্রলোকঃ কেউ ঘরে বসে খায়, আর কেহ মদের
দোকানে বসে খায়।
বন ভন্তেঃ আচ্ছা, মদ খেয়ে রাস্তা ঘাটে
পাগলামি করেনা?
ভদ্রলোকঃ খুব কৃচিৎ।
বন ভন্তেঃ আপনি খান কিনা?
ভদ্রলোকঃ নিশ্চুপ, নির্বাক।
বন ভন্তেঃ এ লোক তোমার কি হয়?
ভদ্র মহিলাঃ আমার স্বামী।
বন ভন্তেঃ এতক্ষণ আমার সাথে কথা বলে আবার বোবা
হয়ে গেল কেন?
ভদ্র মহিলাঃ উনারও অভ্যাস আছে সেজন্য।
বন ভন্তেঃ অপরের কথা বলতে বড় গলা, নিজের
ব্যাপারে কেন বোবা?
ভদ্র মহিলাঃ লজ্জা লাগে সেজন্যে।
বন ভন্তেঃ মদ খেতে লজ্জা লাগে না। মদ পান করা
কোন ধর্মে বিধান নেই। ইহকাল-পরকাল দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই। অতিরিক্ত মদ পানে
সন্তানও হয়না।
দম্পতি কেঁদে ভন্তেকে বললেন-আমরা অপুত্রক।
পুত্রের জন্য আপনার নিকট দোয়া প্রার্থী।
বন ভন্তেঃ বসুন, বসুন। বেশী কথা বলবেন না।
ভদ্র মহিলার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন-আপনার স্বামী কি করেন?
ভদ্র মহিলাঃ ঢাকায় কয়েকটা দোকান ভাড়া ও
কয়েকটি বাড়ী ভাড়া পান। তদুপরি একটা হোটেল পরিচালনা করেন।
বন ভন্তেঃ তা হলে বড় লোক?
ভদ্র মহিলাঃ হ্যা
বন ভন্তেঃ আপনার বিবাহ হয়েছে কত বৎসর?
ভদ্র মহিলাঃ প্রায় এগার বৎসর।
বন ভন্তেঃ কত বৎসর যাবৎ আপনার স্বামী মদ পানে
অভ্যস্থ?
ভদ্র মহিলাঃ বিবাহের আগে হতে।
বন ভন্তেঃ দৈনিক কত টাকা মদ পান করে?
ভদ্র মহিলাঃ কম পক্ষে দেড়শত টাকা।
বন ভন্তেঃ বেশী কত?
ভদ্র মহিলাঃ বন্ধু বান্ধব সহ অনেক টাকার প্রয়োজন।
বন ভন্তেঃ আচ্ছা, আমাকে হিসাব করে দিন, এ
যাবৎ কত টাকার মদ পান। করেছেন?
ভদ্র মহিলাঃ কয়েক লক্ষ টাকার কম হবেনা।
বন ভন্তেঃ তা হলে তার পেটে এক রাজার সম্পত্তি
ঢুকানো হয়েছে।
ভদ্র মহিলাঃ আমার একমাত্র পুত্র সন্তান লাভের জন্য এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক,
আয়ুর্বেদীয় এবং কত কি ঝার ফুক করা হয়েছে। তাতে কোন ফল না পেয়ে লন্ডন যাওয়ার
মনস্থ করেছি। যাওয়ার আগে দেশে দেশে ফকির-দরবেশ, সাধুসন্যাসীদের দোয়া কামনা করছি।
সেজন্য আপনার নিকটও এসেছি। অনুগ্রহ পূর্বক আমাদের দোয়া করুন।
বন ভন্তেঃ আমি দুই একটা কথা বলছি। মনোযোগের সাথে শুনে পালন করবেন।
আপনার শ্বশুর-শাশুড়ী ও মা - বাবাকে আমার কথা বলবেন। আপনার স্বামী দুটার মধ্যে
একটা যেন খায়। সে দুটা কি? মদ আর ভাত। হয়তো শুধু মদ খাবে নতুবা শুধু ভাত খাবে।
দোয়া পরে, আগে আমার দুইটা শর্তের মধ্যে যে কোন একটা পুরণ করতে হবে। ভদ্রমহিলা
হাস্যবদনে ও ভদ্রলোক অধোবদনে চলে গেলেন।
চিত্তের অবস্থা বুঝে করিলে দেশনা।
চিত্ত-অনুকূলে যায় পূরিবে বাসনা।।
মুক্তির পথে
বাঁধা
লোভ, দ্বেষ, মোহ, সৎকায়-দৃষ্টি, বিচিকিৎসা শীলব্রত
পরামাশ, স্ক্যান-মিদ্ধ, উদ্ধত্য, অহী ও অনপত্রপা মুক্তির পথে বাধা।
কিন্তু শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে তাঁর জ্ঞান-দৃষ্টিতে বর্তমানে আরো চারটি
মুক্তির পথে বাধা দেখেছেন।
(১) নানা কবির কল্পনা।
বর্তমানে বিভিন্ন কবি বা চিত্তবিদের চিন্তনীয় বিষয়াদি নিম্নতম
জ্ঞানের প্রকাশমাত্র।
(২) অফুরন্ত খাদ্য ভান্ডার।
বর্তমানে মানুষের খাওয়ার তৃষ্ণা পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেছে।
সুতরাং পৃথিবীর অফুরন্ত খাদ্যে আকর্ষিত হয়ে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করার অন্যতম
কারণ।
(৩) প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য।
পূর্বে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্য খুবই কম ছিল। বর্তমানে পর্যটকেরা
সারা পৃথিবীময় ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য দেখে বিমোহিত হচ্ছে কারণ বর্তমানে
পর্যটনের সুযোগ সুবিধা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
(৪) ইন্দ্রজালের ভেলকির মত বিজ্ঞানের কর্ম।
বর্তমানে মানুষেরা জড় বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন
করে ইন্দ্রজালের ভেকির মত শুধু জড় বিজ্ঞানের মধ্যে জ্ঞান সীমাবদ্ধ রেখেছে। মনোবিজ্ঞান
গবেষণা খুব কমই হচ্ছে।
সুতরাং এই চারটি নিয়ে মানুষেরা লোভ দ্বেষ,মোহগ্রস্ত
হয়ে সুখ দর্শন করে থাকে বর্তমানে এগুলি হতে যাবতীয় দুঃখের সৃষ্টি হচ্ছে, দেখলেই
হতভম্ব হতে হয়।
অতএব লোকোত্তর বা উচ্চতম জ্ঞান না হওয়া
পর্যন্ত কেহ বিবিধ দুঃখ হতে পরিত্রাণ লাভ করবেনা।
মান এর পরিণতি
সুঠাম দেহ, লম্বাচুল-দাড়ি, শরীরে জামা বিহীন এবং
একখানা কালো কাপড় পরিহিত জনৈক ধ্যানী ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয় হয়। তাঁর গুরুর
পরিচয় পেয়ে কথা প্রসঙ্গে আমার গুরু বন ভন্তের কথা উথাপন করি। কিন্তু সে ব্যক্তি
খুব কৃচিৎ অন্য লোকের সাথে আলাপ করেন। একদিন তিনি বন বিহারে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে
অনুরােধ করলেন। যথা সময়ে তাকে বন বিহারে দেশনালয়ের পূর্ব পার্শ্বে পাটিতে
বসালাম। এদিকে বন ভন্তে ধর্মদেশনায় রত আছেন। কিছুক্ষণ পর তার উদ্দেশ্যে কিছু
উপদেশ দেওয়ার জন্য ভন্তেকে অনুরোধ জানালাম। বন ভন্তে শুধু একটা কথা জিজ্ঞাসা
করলেন-তুমি কতটুকু লেখাপড়া করেছ? উত্তরে বললেন-বি.এ. পাশ করেছি। দেশনার প্রারম্ভে
বলেন-অহংকার সব সময় বড় হতে চায়। কিন্তু মান কি জান? মান হল একবার বড়, একবার ছোট,
একবার সমান হয়ে চলাফেরা করা। যদি তোমার একজন বি. এ. পাশের সাথে দেখা হয়, তার
সাথে সমান মনে করোনা। যদি তোমা হতে কম লিখাপড়া ব্যক্তির দেখা হয়, তার সাথে বড়
মনে করোনা। আর যদি তোমা হতে বেশী লিখাপড়া ব্যক্তির সাথে দেখা হয়, তার হতে ছোট
মনানোভাব পোষণ করো না। এতে তোমার চিত্ত কলুষিত হবে। কলুষিত চিত্তে ধ্যান সমাধি
হয়না। মান নয় প্রকার আছে। আপাততঃ বড়, সমান এবং ছোট এই তিন প্রকারের মান ধ্বংস
করতে চেষ্টা কর। দেখবে তোমার ধ্যান সমাধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুবা মান এর
পরিণতি অধোগতি।
আমি
নামে কিছু নাই মানের আকর।
আয়ু
শেষে হয় শুধু যমের চাকর।।
সদ্ধর্ম ও
পরধর্ম
প্রথমে
বন্দনা করি ভন্তের চরণে।
সংঘকে
জানাই নতি আর গুরু জনে।।
উপাসক-উপাসিকা
যত ভক্ত গণে।
নির্বাণ
পথে চলুক লজ্জা ভয় মনে।।
সদ্ধর্ম
ও পরধর্ম ত্রিলোকের মাঝে।
ছায়া
সম চলে সদা পাপ-পূণ্য কাজে।।
পরধর্ম
মারধর্ম অপায়ে চালিত।
সুখ
ভোগ অগ্নিপিন্ড সর্বদা গিলিত।।
পরধর্ম
মুক্ত নয় বহুদোষ তার।
বার
বার ঘুরে ভবে শুধু দুঃখ সার।।
চারি
মার্গ চারি ফল নির্বাণ দর্শনে।
নব লোকোত্তর
সদ্ধর্ম বলে মুক্তগণে।।
শীল
সমাধি প্রজ্ঞার করিলে পুরণ।
সদ্ধর্ম
হবেনা পর হইলে মরণ।।
সর্বধর্ম
সর্বকর্ম ক্ষয় ব্যয় শীল।
অনিত্য
দুঃখ অনাত্ম সর্বদা আবিল।।
সদ্ধর্ম
পরম সুখ নিত্য সুখময়।
চিরতরে
করে ফেলে পঞ্চমার জয়।।
জাতি
ধর্ম বর্ণ গোত্র তাতে মিশে যায়।
সাগরে
নদীর জল খুঁজিয়া না পায়।।
বৈশাখী
পূর্ণিমা লগ্নে মাগি এই বর।
সদ্ধর্মে
থাকিতে পারি দূরে থাক পর।।
এই
কবিতাটি শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের “সদ্ধর্ম
ও পরধর্ম”
নামক দেশনা হতে লিখিত।
শ্রদ্ধারূপ
মুল্য
পটিয়া হতে আগত জনৈক উপাসক
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে জিজ্ঞাসা করলেন- ভন্তে, বিদর্শন কি রকম? বিদর্শন ভাবনা কি
ভাবে করতে হয়?
প্রত্যুত্তরে বন ভন্তে উপমা সহকারে বললেন-ধরুন,
আপনি একটা কাপড়ের দোকানে উপস্থিত হয়ে আপনার জন্য একখানা শাল, স্ত্রীর জন্য শাড়ী
এবং ছেলে মেয়েদের জন্য অন্যান্য কাপড় চেয়ে না কিনে চলে গেলে দোকানদার দুঃখ
প্রকাশ করবেন ত? উত্তরে হ্যাঁ ভন্তে। আপনার পকেটে প্রয়োজন মত টাকা না থাকলে শুধু
শুধু কাপড় দেখা কি উচিৎ? উত্তরে-না, ভন্তে। সেই রকম আপনার অল্প শ্রদ্ধা নিয়ে
বিদর্শন ভাবনা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? বিদর্শন ভাবনা করতে হলে গভীর শ্রদ্ধার
প্রয়োজন। সুতরাং আমার বিদর্শন রূপ দোকানে চাহিদা মত শমখ-বিদর্শন জমাকৃত আছে। আপনি
উপযুক্ত শ্রদ্ধারূপ মূল্য দিয়ে মহামূল্য বিদর্শন ক্রয় করুন। সাগর পাড়ি দিতে বড়
জাহাজের প্রয়োজন,ছোট নৌকা দিয়ে সম্ভব নহে। সে রকম মৃদু শ্রদ্ধা নিয়ে বিদর্শন
ভাবনা হয়না। গভীর শ্রদ্ধা সম্পন্ন ব্যক্তিকে যে কোন সময় বিদর্শন ভাবনা প্রদানে
প্রস্তুত আছি।
শ্রদ্ধারূপ
মূল্য দাও, যদি চাও মুক্তি।
মুক্তির
লগিয়া চল, নাই অন্য যুক্তি।।
সূতার মিস্ত্রীর যন্ত্র
একজন সূতার মিস্ত্রীর বহু সংখ্যক যন্ত্রের প্রয়োজন। প্রয়োজনে
যেটা যেখানে প্রযোজ্য সেটা সেখানে লাগিয়ে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকে। যেমন প্রথমে
হাতুড়ীর প্রয়োজন, পরে বাটালির, এরপর করাতের প্রয়োজন। এ ভাবে সমস্ত যন্ত্র বিভিন্ন
সময়ে ব্যবহার করে থাকে। ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ শমথ ভাবনা করার জন্য যোগীদের
চল্লিশটি উপকরণ তৈয়ার করেছেন। মিস্ত্রীর মত প্রথমে কায়গত স্মৃতি ভাবনা একজন যোগীর
প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ে মৈত্রীর ভাবনা। তৃতীয়ে আনাপান স্মৃতি ভাবনা। ক্রমান্বয়ে
সমস্ত ভাবনা একজন সুদক্ষ যোগীর জন্য একান্ত প্রয়োজন।
তাল-মাত্রা-সুর
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে বিদর্শন ভাবনা সম্বন্ধে বলেন- বিদর্শনগভীর
ভাবে অনুশীলন করতে হয়। বিদর্শনে লোকোত্তর স্তরে উপনীত হওয়া তাতে সর্বদুঃখের
অবসান হয়। যেমন একজন বিখ্যাত গায়ক বহুদিন পর্যন্ত অভ্যাসে তার গানের সংগে তাল,
মাত্রা, ছন্দ মিলায়ে গানের সাফল্য অর্জন করেন। ঠিক সে রকম রকম একজন বিদর্শন
ভাবনাকারী চতুবিধি ইর্ষ্যা পথে যে কোন একটি, কায়ে কায়ানুপসসি, বেদনায়বেদনানুপসসি,
চিত্তে চিত্তানুপসসি এবং ধর্মে ধর্মানুপসসি হয়ে স্মৃতি সহকারে বিদর্শন ভাবনা করতে
পারলে সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
তাল
মাত্রা সুর ছন্দ জানিলে গায়ক।
স্মৃতিতে
চলিলে যোগী ধ্যান সহায়ক।।
মারজয়
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সংক্ষিপ্ত জীবনীতে তার পঞ্চব্রতের
মধ্যে সৈনিকের ব্রত হল পঞ্চমব্রত। সে ব্রতের দ্বারা মারজয় করেছেন। একদিন তিনি
একজন সেনাপতির ভঙ্গিমায় মারজয় দেশনা করেছেন। প্রস্তুত হও। অন্ধকারে আলো জ্বালাও।
বুকে অসীম সাহস নিয়ে এগিয়ে চল। আপদ বিপদ নানাবিধ ভয় আসুক, তবুও সামনের দিকে
এগিয়ে যাও। তোমাদের শক্তিশালী অস্ত্র নিয়ে মারের দিকে এগিয়ে যাও। তোমাদের
দুর্বলতা দূরে ফেলে রাখ। পথ চলতে সুখ অনুভব করবে আনন্দে ডুবে যেওনা। দুঃখে পড়লে
গর্তে পতিত হয়েছ মনে করোনা। নিন্দাতে ফিরে তাকাবেনা প্রশংসায় স্ফীত হওনা। যশে
আকাশে উঠিও না, অযশে পাতালে নামিও না। লাভে নাচিও না, অলাভে কান্দিও না। এই
অষ্টবিধ বাঁধা অতিক্রম করে মারের রাজ্য জয় করে আস। অনেক মাস্তা আছে,তৎমধ্যে শুধু
একটি সঠিক রাস্তা আছে। সে রাস্তায় মারের রাজ্য জয় করা যায়। যেমন ইতিপূর্বে যারা
জয় করেছেন। সে জয় কেমন জয় জান? সারা পৃথিবী তথা দেবলোক ব্রহ্মলোক জয় অপেক্ষা
মারজয় শ্রেষ্ঠ জয়। এ জয়ে পরম সুখ নির্বাণ লাভ করা যায়।
সর্বদাই
থাক যদি পাপে লজ্জা ভয়।
ক্রমান্বয়ে
জয় কর হবে মার জয়।।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত
শিক্ষিত-অশিক্ষি সম্বন্ধে বন ভন্তে দেশনায়
বলেন-বর্তমানে আমাদের দেশে বি.এ. পাশ করলে শিক্ষিত হিসাবে পরিগণিত হয়। কিন্তু এ
শিক্ষা শুধু সংসারের কাজে প্রয়োজন হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে যিনি শীল, সমাধি ও
প্রজ্ঞার শিক্ষা,অভ্যাস পূরণ করেন তিনিই প্রকৃত শিক্ষিত।একজন ডিগ্রীধারী শিক্ষিত
বা ত্রিপিটক বিশারদ যদি অপকর্মে লিপ্ত থাকে, তাকে কি করে শিক্ষিত বলা যায়? বন
ভন্তে প্রায়ই তাঁর দেশনায় উপমা স্বরূপ শ্রীমৎ ডঃ রাষ্ট্রপাল মহাস্থবিরের কথা বলে
থাকেন। রাষ্ট্রপাল ভন্তে একজন ত্রিপিটক বিশারদ, এম. এ. পি. এইচ. ডি এবং বুদ্ধ
গয়ার আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ। একবার বন ভন্তে তাঁকে ...
ডিগ্রীগুলি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। রাষ্ট্রপাল ভন্তে উত্তরে বল্লেন- কলেজ,
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী এবং ত্রিপিটক বিশারদ হল হীন জ্ঞান ও নীচু জ্ঞান। বৌদ্ধ মতে
তা কাজে আসেনা।লোকোত্তর জ্ঞানই উত্তম জ্ঞান ও উচ্চতর জ্ঞান। সর্বদুঃখ হতে মুক্ত
হওয়া যায়। সেজন্য বন ভন্তে শিক্ষিত কাকে বলে পুনঃ পুনঃ ব্যাখ্যা করে থাকেন। আমি
নিজেও শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপাল ভন্তের দেশনা শুনেছি। তার দেশনায় অন্যান্য ডিগ্রীগুলিকে
হীন, তুচ্ছ, নীচু অসম্পূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বুদ্ধজ্ঞান অর্থাৎ লোকোত্তর
জ্ঞানই আসল শিক্ষিতের জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন।
লিখাপড়া
শিখে তুমি গর্ববোধ কর।
মান
তৃষ্ণা ত্যাগী বুদ্ধ পথ ধর।।
নির্বাণ কার জন্য?
বন ভন্তে দেশনায় বলেন-নির্বাণ উচ্চ শিক্ষিতের জন্য
নহে। ধনী দরিদ্রের জন্যও নহে। প্রার্থনাকারী বা যজ্ঞকারীর জন্যও নহে। কোন অজ্ঞ
অথবা পন্ডিতের জন্যও নহে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিকল ব্যক্তির জন্যও নহে। তবে নির্বাণ
কার জন্য?
সরল সোজা, উদ্যমশীল মুক্তিকামী, অবিদ্যা, তৃষ্ণা, মান ধ্বংসকারী
এবং অষ্টবিধ লোক ধর্মে অকম্পিত আয্যগণের জন্য
নির্বাণ। ক্ষমাশীল, দয়াশীল, দয়ালু নির্ভীক, ধীর ও স্থির ব্যক্তির জন্য নির্বাণ
প্রত্যক্ষ বা লাভ করার জন্য তৎপর হওয়া উচিৎ। ঘরে আগুন লাগলে প্রাণ ভয়ে লোক
বাহিরে চলে যায়। সেরূপ তোমরা অবিদ্যা-তৃষ্ণা হতে বাহির হয়ে মুক্ত হও। তিনি আরো
বলেন-নীচের এই তিনটির সমন্বয়ে নির্বাণ লাভ করা যায়।
পূর্বের
সঞ্চিত পূণ্য১ বুদ্ধের নির্দেশ২।
নিজের
চেষ্টায়৩ হয় নির্বাণ উন্মেষ।।
বিশ্বাসী কে?
শ্রদ্ধেয়
বনভান্তে আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন- এ পৃথিবীতে মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র,
আত্নীয়-স্বজন, দেশবাসী, ভিক্ষু-শ্রমণ,স্ত্রী-পুরুষ, যুব-বৃদ্ধ, পণ্ডিত প্রভৃতি সকল
জাতীয় মানুষ বিশ্বাসী নয়। এমনকি যে দান করে তাঁকেও বিশ্বাস করা যায়না। যে ধ্যান সমাধি
করে তাঁকেও বিশ্বাস করা যায়না। কারণ তারা ধর্মেরও অধীন কর্মেরও অধীন। মৃত্যুর পর তাদের
চারি অপায়ে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।তাঁরা জন্মে জন্মে বিভিন্ন যোনিতে ভ্রমন করে অনন্ত
দুঃখের ভাগী হন।তা হলে তাঁদেরকে কিভাবে বিশ্বাস করা যায়? একমাত্র বিশ্বাসী কি?বিশ্বাসী
হল যিনি কর্মফল বিশ্বাস,ইহকাল ও পরকাল বিশ্বাস এবং চতুরার্য্য সত্যকে বিশ্বাস অর্থাৎ
চারি অপায় বন্ধ করে মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁকেই বিশ্বাসী বলে।তোমরা প্রকৃত বিশ্বাসী
হওয়ার জন্য চেষ্টা কর, প্রকৃত বিশ্বাসীরাই পরম সুখী ও স্বাধীন।
আত্নীয় বন্ধু বান্ধব সকল অলাভ।
কেবল বিশ্বাস কর মার্গফল লাভ।।
ইন্দ্রিয় দমন
বন ভন্তে ইন্দ্রিয় দমন সম্বন্ধে উদারহণ স্বরূপ
বলেন-যেমন ধর একজন রাখাল পাচটি গরু নিয়ে চারদিকে ধানক্ষেতের মাঝখানে খালি
জায়গায় গরু চড়াচ্ছিল। তার গরুগুলি সে জায়গায় ঘাস খেতে খেতে ধান ক্ষেতে চলে
যায়। এভাবে পাঁচটি গরু চড়াতে তার কষ্ট হচ্ছিল এবং ধানেরও ক্ষতি হচ্ছিল। যেখানে
বিস্তীর্ণ ঘাসময় এলাকা এবং কোন ধান ক্ষেতও নেই সেখানে গরু চড়াতে কোন কষ্ট হয়না
এবং ধানেরও ক্ষতি হয়না। .
বর্তমানে যারা ইন্দ্রিয় দমন করতে তৎপর, তারা অনেক কষ্টের মধ্যে
ইন্দ্রিয় দমন করে থাকে। যেমন চারিদিকে দুঃশীল পরায়ণ এবং নানা প্রতিবন্ধকতার
মধ্যে দিয়ে ইন্দ্রিয় দমন করতে হয়। চিত্তরূপ রাখালেরও চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা,
জিহ্বা ও ত্বক রূপ পঞ্চ গরু নির্জনে ও প্রতিবন্ধকতাহীন জায়গায় ইন্দ্রিয় দমন
করতে অত্যন্ত সহজসাধ্য হয় এবং মহা সুখে কাল যাপন করতে পারে।
মহাসুখে থাকবে তুমি ইন্দ্রিয় দমিয়া।
পুনঃ পুনঃ না জন্মিবে নির্বাণ লভিয়া।।
চিত্ত দমন
বন ভন্তে চিত্ত দমন সম্বন্ধে উপমায় বলেন- বৃষভ (ষাঁড়)
কি করে জান? একটু সুযোগ পেলে লোকের ক্ষেত-চাষ নষ্ট করে দেয়। এমন কি শক্ত
ঘেরা-বেড়া পর্যন্ত ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এত শক্তিশালী যে তাকে বাধা দেওর
ক্ষমতা কেহ রাখেনা। বুদ্ধির জোরে লোকে একে গলায় ও মুখে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে রাখে
এবং ইচ্ছামত শিক্ষা দিতে থাকে। বিভিন্ন প্রকারে শিক্ষা দিয়ে বাধ্যগত করে ও দমিত
হয়ে শান্ত প্রকৃতির হয়। পরিশেষে হাল ও গাড়ীর কাজে ব্যবহৃত হয়। সে রূপ চিত্তের
বৃষভের মত কিন্তু চিত্তের শক্তি বৃষভ হতে লক্ষগুণ বেশী। চিত্ত লোভ, দ্বেষ,মোহর স্রোতে
পড়ে কোথায় যে চলে যায় তার কোন সীমা থাকেনা। এমন কি এক মুহুর্তে অপর এক প্রান্ত
থেকে অপর প্রান্তে চলে যায়। তার কোন পাসপোর্ট-ভিসারও প্রয়োজন হয়না। চিত্তকে দমন
করা কঠিন ব্যাপার। জ্ঞানীরা চিত্তকে সুক্ষ্ম স্মৃতি রশি দিয়ে শক্ত ভাবে বন্ধন করে
সংযম শিক্ষা দিতে থাকেন। সংযমিত চিত্ত শান্ত ও স্থির হয়। শান্ত ও স্থির চিত্ত
কুশল উৎপন্ন করে নির্বাণ অভিমুখী হয়। বন ভন্তে আরো বলেন-চিত্ত দমন করা মহাসুখ। তা’তোমাদের
সর্ব দুঃখ মোচনের সহায়ক হবে।
দান্ত চিত্ত কুশল চিত্ত করে উৎপাদন।
জ্ঞান ধ্যানে সদা কর মার্গফল পুরণ।।
মদ্যপায়ীর পঞ্চ অবস্থা
শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তে মদ্যপায়ী সম্বন্ধে বলেন-যারা মদ পান করে তারা সহজে মদ ছাড়তে পারে না।
কারণ তারা এক প্রকার আবর্তে পড়ে। সে আবর্ত থেকে খুব কম লোকই উঠতে পারে। তারা মদ
ছাড়তে পারবে একদিন। কোন দিন জান? যেদিন মনুষ্য দেহ ত্যাগ করে গরু, মহিষ, নানাবিধ
পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, ভূত-প্রেত ও যক্ষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করবে সেদিন মদ ছাড়বে।
তির্যক প্রাণী বা যক্ষেরা মদ কোথায় পাবে? ইহজীবনে যা পারে তা পান করছে। ইহ জীবনে
মদ খোরের পাঁচ রকম অবস্থা হয়ে থাকে। যেমন শুকর যেখানে সেখানে শুয়ে থাকে, অন্য
প্রাণীর মত নির্দিষ্ট কোন থাকার জায়গা নেই তারাও মদ পান করে যেখানে সেখানে শুকরের
মত পড়ে থাকে ও হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। বাদুর মুখে খায় আবার মুখে পায়খানা করে।
বাঘ সব সময় হিংস্র স্বভাবের হয়ে থাকে। মদ্য পায়ীরা মদ পান করে হিংস্র হয়ে উঠে।
শকুন পচা মাংস খেয়ে আকাশে উঠে এবং নীচের পচা দ্রব্যের দিকে তাকিয়ে থাকে সে
প্রকার তারাও ক্ষণিকের জন্য বড় লোক সেজে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করে। কুকুর পথে
ঘাটে যেখানে সেখানে কামভাব চরিতার্থ করে। তারাও মদ পান করে কুকুরের স্বভাবে পরিণত
হয়। মদ পানের ফলে পঞ্চ অবস্থায় পরিণত হয় এবং মৃত্যুর পর পঞ্চকুলে জন্ম গ্রহণ
করে। কেহ কেহ ভূত, প্রেত, যক্ষ ও অন্যান্য তির্ষ কুলে জন্ম গ্রহণ করে। এমন কি ভীষণ
যন্ত্রণাদায়ক নরকে পতিত হয়। মনুষ্য জন্ম খুবই দুর্লভ। এ দুর্লভ জন্ম হারালে
বর্ণনাতীত অপায় দুঃখ ভোগ করতে হয়। সুতরাং যাদের মদ পান করার কু-অভ্যসা আছে,
তাদের অনতিবিলম্বে মদ ত্যাগ করা একান্ত উচিত। জনৈক মদ খোর মারা যাওয়ার পর আমি বন
ভন্তের নিকট জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে ব্যক্তি যক্ষ বা অন্য কোন হয়েছে কিনা? বন ভন্তে
সঙ্গে সঙ্গে বললেন-সেই ব্যক্তি আগে থেকে নরকে পাঁচ একর জমি বন্দোবস্তি করে রেখেছে?
যক্ষ হলে অনেক ভালই হতো।
বনভন্তের শর্ত
বন বিহারে
যদি কেহ প্রব্রজ্যা বা উপসম্পাদার জন্যে আসে, প্রথমে বনভন্তে কতগুলি শর্ত আরোপ
করেন। যেমন টাকা-পয়সা গ্রহণ না করা। ক্রয় বিক্রয় না করা। রাত্রে চার ঘন্টা
ব্যতীত অন্য সময় ঘুমাতে পারবেনা নারীর সাথে আলাপ করতে পারবেনা। কি খাবে? কোথায়
খাবে? আমার বিছানা কোথায়? কে আমাকে পালন করবে? এগুলি চিন্তা হতে বিরত থাকতে হবে।
বাড়ীতে লিখাপড়া যা হয়েছে তা যথেষ্ট, এখানে লিখাপড়া করতে পারবেনা। গল্প বা বাজে
আলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। বন ভন্তের অনুগত হয়ে শ্রমণ-ভিক্ষুর যা যা প্রয়োজন তা
অবশ্যই পালন করতে হবে। প্রব্রজ্যা বা ভিক্ষু হওয়ার জন্য আসলে মধ্যে মধ্যে
বলেন-তুমি কি রকম? দূর শিরা না ছিড়কার? দুর শিরা অর্থ কচ্ছপের মাথা একবার ভিতরে
ঢুকায় আবার বাহির করে। এ ভাবে ঢুকানো আবার বাহির করা কচ্ছপের কাজ। সে রকম অনেকে
একবার ভিক্ষু হয়, আবার গৃহী অবস্থায় ফিরে যায়। এ ভাবে পুনঃপুনঃ ভিক্ষু এবং গৃহী
হওয়াকে বন ভন্তে দুরশিরা বলেন। ছিড়কার অর্থ হল একখানা রশি দুই মাথায় দুইজনে
টানলে বা মধ্যখানে অন্যজনে কেটে দিলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ সংসার ধর্ম
সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন করে পারমার্থিক ধর্মে চলে যাওয়াকে বনভন্তে ছিড়কার বলেন।
বহুশর্ত আরোপের পর উপমায় বলেন-ধর, ঢাকা যাওয়ার জন্যে গাড়ীতে উঠেছ হঠাৎ পথেনেমে
গেলে, ঢাকা যাওয়া হবে কি? যাওয়া হবেনা, সুতরাং তোমার উচিত না নেমে ঢাকায় পৌছা
সে রকম প্রত্যেক মুক্তিকামী নির্বাণ লাভ না হওয়া পর্যন্ত শমথ-বিদর্শন ভাবনা বা
প্রব্রজ্যা ত্যাগ করতে পারবেনা। এভাবে যাবতীয় শর্ত আরোপের পর স্বীকারোক্তিপত্রে
দস্তখত করতে হয়।
একদিন জনৈক পৌঢ় ব্যক্তি আগে থেকেই ভিক্ষু হওয়ার জন্য প্রস্তুতি
নিচ্ছিলেন। বন ভন্তে তাকে বললেন-তুমি ত বিবাহিত। তোমার ছেলে মেয়ে এবং সব কিছু
আছে। আচ্ছা তুমি ভিক্ষু হওয়ার পর তোমার স্ত্রী বিহারে আসলে কি মনে করবে? তিনি
বললেন- উপাসিকা মনে করবো। বন ভন্তে আবার বললেন-আচ্ছা, বহুদিন পর তোমার স্ত্রী অন্য
জনের সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হলো,সে লোকের সাথে চলে যাওয়ার সময় তোমাকে বন্দনা করে
বলল -আমি এ লোকের সাথে চলে যাচ্ছি। তখন কি করবে? তিনি বললেন-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দেবো।
বন ভন্তে বললেন- তা হলে ঠিক আছে। তুমি আগে মারামারি শেষ করো, এখন তোমার ভিক্ষু
হওয়ার দরকার নেই। তোমার মত শিষ্য আমার প্রয়োজন নেই। বন ভন্তে বিভিন্ন সময়ে এ
ভাবে পরীক্ষা করে হীন ভিক্ষু না হওয়ার জন্য বলেন, যারা উদ্যমশীল, মুক্তিপ্ররায়ণ
এবং ভন্তের শর্তগুলি পুংখানুপুংখরূপে প্রতিপালনে প্রতিজ্ঞ, তারা প্রব্রজ্যা বা
উপসম্পদা লাভ করতে পারে।
অংক
মিলিলে হয় ছাত্রের আনন্দ অপার।
বন
ভন্তের শর্ত পূরিলে হয় পরাজয় মার।।

কে পায় কে পায়না?
বহুদিন
যাবৎ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার সমবয়সী না হলেও আমার সাথে দোকানে বসে নানা শাস্ত্র আলোচনা
করতেন। মধ্যে মধ্যে তিনি এমন প্রশ্ন কতেন যা যথাযথ উত্তর দিতে সক্ষম হতাম না। কারণ
তিনি পন্ডিত লোক। একদিন তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন- “আমরা মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যা কিছু ধর্ম কর্ম করে
থাকি তা কে পায় কে পায়না? প্রশ্নটির উত্তর আমি নিজে বুঝি, অথচ পন্ডিত বৃদ্ধকে
ভাল ভাবে বুঝাতে পারি না। তিনি বলেন- চলুন তা হলে বন ভন্তের নিকট যাই। একদিন
বন্দনার পর বন ভন্তেকে আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত করলাম। তিনি প্রথমে
সংক্ষিপ্ত এবং পরে বিশদ ভাবে তা ব্যাখ্যা করে বলেন-মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ধর্ম
করা প্রত্যেকের কর্তব্য। তা শাস্ত্রে বিধান আছে। তিনি উপমায় বলেন-ধরুন, আপনাদের
ভাই ঢাকা থাকেন। তাঁর উদ্দেশ্যে পাচশত টাকা মনিঅর্ডার করলেন। আপনার ভাই সে
ঠিকানায় থাকলে টাকাগুলি পাবেন ত? তিনি বলেন-হ্যাঁ ভন্তে। যদি সে ঠিকানায় না
থাকেন, আপনার টাকা আপনার নিকট ফেরত আসবে ত? তিনি বললেন-হ্যা, আসবে ভন্তে। তা হলে
মৃতব্যক্তির বেলায়ও সে রকম হবে। যদি থাকে পাবে, আর যদি না থাকে পাবেনা। অর্থাৎ
পুণ্য কর্মদাতারকাছেফেরৎ এসে পূণ্য বর্ধিত হবে। ভন্তে আবার বললেন-মানুষ মারা
যাওয়ার পরে বিশেষ প্রেত বা পরদত্ত ভোগী ব্যতীত একত্রিশ লোক ভূমির মধ্যে যে কোন
ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করলে সে পূণ্য দান পাবে না। শুধু সে প্রেত লোকেই পাবে। আবার
প্রেতলোকের মধ্যেও না পাওয়ার অবস্থা আছে। সুতরাং মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যদান
করা প্রত্যেকের কর্তব্য। এ উদ্দেশ্যে বহু দেশনার পর বৃদ্ধলোক বলেন-কে পায় কে পায়না
কিভাবে জানা যায়? বন ভন্তে উত্তরে বললেন-যার চক্ষু খোলা তিনি জানেন। যার চক্ষু
বন্ধ তিনি জানেন না। অর্থাৎ চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখা যায়না। জ্ঞান চক্ষু দিয়ে দেখা
যায়। জ্ঞান চক্ষু যার নাই তার মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ধর্মকর্ম করা উচিৎ। এরপর আলো
আলাপ আলোচনার পর বৃদ্ধ ভদ্রলোক সহ চলে আসলাম।
আর একদিন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন-তুমি এমন
প্রশ্নকারী আনিও, সে যেন শুধু জানার উদ্দেশ্যেই আসে। উপমায় বলেন-ঐ দেখ সাপছড়ি
পাহাড়। সেটার সাথে কেহ যেন ধাক্কা খেয়ে না যায়।
জ্ঞান তরে প্রশ্ন কর অন্যথায় নয়।
জন্মে জন্মে জ্ঞানী হও কর মারজয়।।
তাবিজের সন্ধানে
জনৈক
মহিলা আলুথালু বেশে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সমীপে উপস্থিত হয়ে অন্যান্য উপাসিকাদের
পাশে বসে আছে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত বন ভন্তের দেশনা শুনেও চাকমা ভাষা কিছু বুঝতে
সক্ষম হয়নি। বন ভন্তেকে মহিলা কাতর কণ্ঠে বল- ভন্তে, আমি আপনার কাছে একটা বিশেষ
দরকারে এসেছি। বন ভন্তে বলেন- কি ব্যাপার। মহিলা বল-ভন্তে ব্যাপারটি আপনার কানে
কানে চুপে চুপে বলতে হবে। বন ভন্তে বললেনআমাদের বৌদ্ধ বিনয় মতে যে কোন মহিলা
ভিক্ষুর সাথে কানে কানে চুপে চুপে কথা বলতে পারে না। মহিলা বলল- ভন্তে, সেটা অতীব গোপনীয়
ও লজ্জার কথা। তারপর তোমার পাশের মহিলাকে খুলে বলো। সে আমাকে বড় করে বুঝিয়ে
বলবে। তার পাশের চাকমা মহিলা তার বিষয়টি শুনে বন ভন্তেকে বুঝিয়ে দিল। তার বাড়ী
ময়মনসিংহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে। অধ্যয়নরত একছেলের সাথে তার
ভালাবাসা জন্মে। শেষ পর্যন্ত তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার অঙ্গীকার করে।
কিন্তু ছেলেটি অন্য আর এক মেয়ের সাথে ভালবেসে তার কথা একেবারে ভুলে যায়। শত
চেষ্টার ফলেও তার বশবর্তী হয়না। আজ অনেক দিন যাবৎ এ কারণে মানসিক কষ্টে ভুগতেছে।
ঢাকায় আপনার নাম শুনে একটা তাবিজের জন্য এসেছি। সে তাবিজের গুণে যেন তাকে পুনবার
ভালবেসে বিয়ে করতে পারি। সমস্ত বিষয়বস্তু শুনে বন ভন্তে বললেন-সে ছেলেটি হল
অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতক। তোমার ভাগ্য ভাল। যদি তোমাকে বিবাহ করে ছেড়ে দিত কি
অবস্থা হত? বিশ্বাসঘাতকের সাথে পুনঃবার বিশ্বাস স্থাপন করা তোমার উচিৎ হবেনা। সে
যখন তোমাকে ভুলে গেছে, তুমিও তাকে একেবারে ভুলে যাও। যেমন টেপরেকর্ডারে গান বা
অন্য কিছু অপছন্দ হলে সেগুলি মুছে পছন্দ মত গান বা অন্য কিছু রেকর্ড কর, সে রকম,তোমার
মন থেকে তার কথা মুছে ফেল। মনে কালিমা রাখা দুঃখজনক। যেমন তুমি মনে কষ্ট পেয়ে
পেয়ে ভুগতেছ। আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি-তুমি শান্ত চিত্তে পুনঃবার লেখাপড়া
আরম্ভ কর-মানসিক কষ্টে আর ভুগতে হবেনা, তোমার নিশ্চয় সুখ এবং মঙ্গল হবে। ইহাই তোমার
উত্তম তাবিজ। অতপর উক্ত উৎকণ্ঠিত মহিলা উপাসিকাদের সাথে পঞ্চশীল গ্রহণ এবং বন
ভন্তের গভীর ধর্ম দেশনা শুনে উস্ফুল্ল চিত্তে চলে যায়।

দেহ কলসী তুল্য
শ্রদ্ধেয়
বনভন্তে নশ্বর দেহ সম্বন্ধে দেশনায় বলেন-দেহ হল কলসী তূল্য। যেমন মাটির কলসী,
এলুমিনিয়ামের কলসী এবং পিতলের কলসী। মাটির কলসী দামেও কম স্থায়ীত্বও কম।
এলুমিনিয়ামের কলসী দামেও বেশী স্থায়ীতুও বেশী। পিতলের কলসী দামে আরো বেশী
স্থায়ীত্ব আরো বেশী তাহলে দেখা যায় কলসীর মধ্যে দামে ও স্থায়িত্বে তারতম্য
পরিলক্ষিত হয়। মনুষ্য দেহ হল মাটির কলসী। মাটির কলসী কখন ভেঙ্গে যায় তার কোন
নিশ্চয়তা নেই। না ভাঙ্গলে বেশ কিছু দিন ব্যবহার করা যায়। ঠিক তেমনি মনুষ্য দেহ
কখন ধ্বংস হয় তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কেহ শিশু কালে, কেহ কিশোর কালে, কেহ পৌঢ়
কালে এবং কেহ বৃদ্ধকালে বা যথা সময়ে মৃত্যু বরণ করে। যদিও শত বৎসর জীবিত থাকে
তবুও স্বর্গের তুলনায় স্বল্প আয়ু। যদি কোন লোক মনুষ্য লোকে সৎকর্ম ও শীল পালন
করে স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়, স্বর্গে উৎপন্ন হলে এলুমিনিয়ামের কলসীরূপে দেহ ধারণ
করে থাকে। পৃথিবীতে এলুমিনিয়ামের কলসী যেমন অনেকদিন পর্যন্ত স্থায়ী তেমনি
স্বর্গে হাজার হাজার বৎসর স্বর্গভোগ করে থাকে। তাও ব্রহ্মলোকের তুলনায় স্বল্প
আয়ু।
যদি কোন লোক মনুষ্যলোকে দান, শীল, ভাবনা কর ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হয়।
তার দেহ ধারণ পিতলের কলসী তুল্য হয়। পিতলের কলসী যেমন বহুদিন স্থায়ী থাকে তেমনি
ব্রহ্মলোকেও লক্ষ লক্ষ বৎসর আয়ু সম্পন্ন হয়ে ব্রহ্মলোকে থাকে।
মনুষ্যলোকের যাবতীয় সুখ ভোগকে তৃতীয় শ্রেণীর সুখ বলা হয়। কারণ
এখানে সুখ ও দুঃখ মিশ্রিত। দেব সুখ বা স্বর্গভোগ দ্বিতীয় শ্রেনীর সুখ পরিলক্ষিত
হয়। সেখানে শুধু সুখই বিরাজমান। দুঃখ মিশ্রিত নেই। ব্রহ্মসুখ হলো প্রথম শ্রেনীর
সুখ। সবসময় প্রীতি সুখে কাল যাপন করে।
ভগবান বুদ্ধের মতে মনুষ্য সুখ, দেব সুখ ও ব্রহ্মসুখ তেমন কিছু নয়
বিমুক্তি সুখ আসল সুখ। যাঁরা শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণতা লাভ করে
শ্রোতাপত্তিমার্গ, শ্রোতাপত্তিফল, সকৃদাগামীমার্গ, সকৃদাগামীফল, অনাগামীমার্গ,
অনাগামীফল,অর্হত্ব ও অর্হত্ব ফলের অধিকারী হয়েছেন তারাই প্রকৃত সুখের অধিকারী। তাঁদের
দেহ ধারণ বা যে কোন কলসী রূপে গঠন হওয়া দুঃখজনক। যাঁরা অবিনাশী সুখ বা নির্বাণ
লাভ করার উদ্দেশ্য থাকে তাঁরা কামলোক, রূপলোক ও অরূপলোককে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম
ভাবে দর্শন করা উচিৎ। মুক্তিকামী ব্যক্তিরা ত্রিলোককে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড হিসাবে
দেখিয়া-থাকেন।
ফেনতু্ল্য দেহ সব দুঃখের
আগার।
অনিত্য দর্শনে হয় ভব
পারাপার।।
বন ভন্তের
ভবিষ্যদ্বাণী
শ্রদ্ধেয়
বনভন্তের সংস্পর্শে যাঁর আছেন তারাই উত্তমরূপে বন ভন্তে সম্বন্ধে নিজের সামর্থ্য
অনুযায়ী অবগত থাকবেন। প্রথমেই তাঁর শিষ্যমন্ডলীর মধ্যে ভিক্ষু শ্রমণই প্রধান। দ্বিতীয়তঃ
উপাসক-উপাসিকাদের মধ্যে কেহ কেহ বিক্ষিপ্তাকারে তাঁর মুখ নিঃসৃত ভবিষ্যত বাণীগুলি
স্মৃতিপটে ধারণ করে রাখেন। আবার কেহ কেহ তাঁর বাণীগুলি সযত্নে লিপিবদ্ধ করে রাখেন।
তিনি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন উপলক্ষে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গক্রমে প্রজ্ঞাচোখে
নিরীক্ষণ করে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে থাকেন। তন্মধ্যে আমার জানা মতে তাঁর বহু
ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্য মাত্র গুটিকয়েক উদাহরণ হিসেবে পাঠক-পাঠিকার জ্ঞাতার্থে প্রকাশ
করছি।
১। স্বাধীনতার যুদ্ধঃ
১৯৭০ ইংরেজীতে শ্রদ্ধেয় বনভন্তে দিঘীনালা হতে লংগদুর তিনটিলায়
চলে আসেন। তখন হতে আমি মধ্যে মধ্যে তার দর্শনার্থে যেতাম। এমন কি বনভন্তের প্রধান
দায়ক বাবু অনিল বিহারী চাকমার (হেডম্যান) বাড়ীতে কয়েকদিন পর্যন্ত অবস্থান
করতাম। ১৯৭১ ইংরেজীর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহবানে তৎকালীন সারা
পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল তখন আমি সেখানে ছিলাম। একদিন দেশনার ফাঁকে
তিনি বললেন-“দুঃখ,
দুঃখ, দুঃখ, রক্তপাত, রক্তপাত রক্তপাত নয় মাস থাকবে!” দেখা গেল, কয়েকদিন পর ঠিক
নয় মাস পর জন্ম হল এক নূতন বাংলাদেশ। তখন হতে তার প্রত্যেকটি ভবিষ্যদ্বাণী
অব্যর্থ সত্যে পরিণত হতে লাগল।
২। শেখ মুজিবের মৃত্যুঃ
১৯৭৫ ইংরেজীর ১৩ইং আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বেতবুনিয়া
ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সে সময় শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে বন বিহারে দেশনালয়ে
উপাসকউপাসিকাদের উদ্দেশ্যে দেশনা করছিলেন। দেশনার মাঝখানে তিনি বলেন- “অনেক সময় পঞ্জিকার কথাও
সঠিক থাকে।”
জনৈক উপাসককে পঞ্জিকা খুলে দেখার জন্যে নির্দেশ দিলেন। পঞ্জিকাতে লিখা আছে
বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের অপমৃত্যু। ১৬ই আগষ্ট সকাল বেলা রেডিওতে শুনতে
পেলাম সেনাবাহিনী কর্তৃক শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। দেশনালয়ে যাঁরা উপস্থিত
ছিলেন-তাঁদের মধ্যে বাবু জ্যোতির্ময় চা (অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্রেট) ও বাবু
রাজমঙ্গল চাকমা উল্লেখযোগ্য।
৩। জনৈক ভিক্ষু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীঃ
বন ভন্তের বিরুদ্ধবাদী জনৈক ভিক্ষু তাঁর বিরুদ্ধে নানা প্রকার
কুৎসা রটনা ও অপপ্রচার চালাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে উপাসকদের মধ্যে মারামারি হওয়ার
উপক্রম হয়।
এমনকি বন ভন্তের অনুসারীদের
মধ্যে অঞ্চল ভেদে আমরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলাম। এ ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তেকে জানানোর পর তিনি আমাকে বললেন- শৃগাল সিংহ কোনদিন দেখেনি। না বুঝে না জেনে
শৃগাল শুধু লাফালাফি করতেছে। সিংহ চিনতে পারলেই শৃগাল পালিয়ে যাবে” সত্যি সত্যিই কয়েকমাস পর
উক্ত বিরুদ্ধবাদী ভিক্ষু হঠাৎ অন্যত্র চলে যান।
৪। জেনারেল মঞ্জুরের মৃত্যুঃ
জেনারেল মঞ্জুরের মৃত্যুর কয়েকমাস পূর্বে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে
ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন-“জেনারেল
মঞ্জু নির্দোষী লোক হত্যা করেছে। তাঁর অকাল মৃত্যু অনিবার্য।” শেষ পর্যন্ত দেখা গেল প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমানের হত্যার পর তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
৫। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুঃ
১৯৮৪ ইংরেজীত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস্ ইন্দিরা গান্ধী তাঁর
দেহরক্ষীর হাতে নিহত হওয়ার পর রাজীব গান্ধী অস্থায়ীভাবে প্রধানমন্ত্রী হন। এ খবর
বন ভন্তেকে জানানোর পর তিনি সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে বললেন-“রাজীবকেও মেরে ফেলবে।” অনেক দিন পর আমি চিন্তা
করলাম-অনেক সময় দেখা যায় মানুষ পূণ্য কর্মের দ্বারা বিপদ কেটে যায়। কিন্তু শেষ
পর্যন্ত ১৯৯০ ইংরেজীতে জনৈক তামিল মহিলার হাতে রজীব গান্ধী নিহত হন।
৬। কতিপয় ভিক্ষুর উদ্দেশ্যে ভবিষ্যদ্বাণীঃ
কতিপয় লাভ-সৎকার লাভী ভিক্ষু শ্রদ্ধেয় বনভন্তে কর্তৃক তিরস্কৃত
হওয়ায় তাকে একঘরে করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে বন ভন্তে দেশনা
প্রসঙ্গে বলেছিলেন-“আমি
পরমার্থ সংঘকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও বন্দনা করি। সত্যকে যেমন মিথ্যা চিরদিন ঢেকে
রাখতে পারেনা তেমনি চন্দ্র সূর্যকেও মেঘে চিরদিন ঢেকে রাখতে পারেনা।
কালক্রমে দেখা গেল উক্ত লাভ সৎকারী লাভী ভিক্ষুর লাভ-সত্তার দিন
দিন হাস পেতে থাকে এবং শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের প্রতি উপাসক-উপাসিকাদের গভীর শ্রদ্ধা
বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৭। ইরাকের যুদ্ধঃ
ইরাক যুদ্ধের পূর্বে আমার মনে উদয় হল যদি বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায়
সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ মারা পড়বে। এ উৎকণ্ঠা নিয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে
জিজ্ঞাসা করি তাতে তিনি নীরব রহিলেন। দ্বিতীয় বার আর একদিন জিজ্ঞাসা করার পর তিনি
বললেন “বিশ্বযুদ্ধ
হবেনা। অজ্ঞানে অজ্ঞানে যুদ্ধ হবে”। বনভন্তের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি অনেকের নিকট ইরাক
যুদ্ধের ভবিষ্যত নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে প্রচার করেছি। পরবর্তীতে দেখা গেল তা বিশ্ব
যুদ্ধের পর্যায়ে যেতে পারেনি।
৮। বেঁচে থাকলে শ্রমণ হতে পারোঃ
বাবু সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া কাপ্তাই এ চাকুরী করেন। তিনি আমার মামা
শ্বশুর হন। মধ্যে মধ্যে বন বিহারে দেখা হয়। এমন কি তিনি সস্ত্রীক উপোসথও পালন করে
থাকেন। একবার তাঁর মনে উদয় হল-অষ্ট পরিস্কার দান করবেন ভন্তের নিকট শ্রমণ হলে ভাল
হয়। চিত্তে এ সংকল্প করে শ্রমণ হওয়ার জন্য তিনি প্রার্থনা করলেন। বন বিহারের
নিয়ম অনুযায়ী কমপক্ষে পনের দিনের জন্য শ্রমণ ধর্ম পালন করতে হয়। এদিকে সরকারী
ছুটি সাত দিনের অধিক পাওয়া যাচ্ছেনা বিধায় তার উদ্দেশ্য পুরণ হলনা। কিছুদিন পর
পুনরায় তিনি প্রার্থনা করলেন-শ্রদ্ধেয় ভন্তে অনুকম্পা পূর্ব আমাকে দশদিনের জন্য
হলেও প্রব্রজ্যা দান করুন। তাতে বন ভন্তে বললেন- “বেঁচে থাকলে শ্রমণ হতে পার”। বুদ্ধের সময়েও তোমার মত
জনৈক উপাসক বুদ্ধের নিকট শ্রমণ হতে পারেনি। বন ভন্তের অনুমোদন পেয়ে তিনি উৎফুল্ল
চিত্তে কাপ্তাই চলে গেলেন।
এদিকে অফিসের জমাকৃত কাজ রাতদিন একটানা করার ধুম পড়ে গেল। একদিন
সাড়ে নয়টায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় বেবী টেক্সীর ধাক্কায় ক্ষত
বিক্ষত অবস্থায় রাস্তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন, তার জনৈক বন্ধু তাঁকে চিনতে
পেরে হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত সাড়ে তিনটায় জ্ঞান ফিরে আসে। তখন বনভন্তের
ভবিষ্যত বাণীর কথা স্মরণ করে চিন্তা করলেন-জীবনে যখন বেঁচে গেলাম নিশ্চয় আমি
শ্রমণ হতে পারব। হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়াই বন বিহারে
চলে আসেন।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের ভবিষ্যত বাণী,দুর্ঘটনা ও তার শরীরের অবস্থা
দেখে আমি সত্যিই আশ্চর্যন্বিত হলাম। এ ব্যাপারে ভন্তেকে অবহিত করার পর তিনি আমাকে
নির্দেশ দিয়ে বলেন-“তাকে
শ্রমণ হওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।”

ধর্মবাবা
লৌকিক ভাবে দেখা যায় পিতাপুত্রের সম্পর্ক খুবই গভীর।
এমনকি চেহারা ও রক্তের দিক দিয়ে মিল দেখা যায়। একজন শিশু তার বাবাকে বাবা বলে
ডাকতে ডাকতে অভ্যস্থ হয়। আবার যৌবন কালে তার শ্বশুরকেও বাবা বলে সম্বোধন করে।
ভিক্ষু-শ্রমণ, সাধু-সন্যাসী, ফকির ও দরবেশদেরকেও অনেকে বাবা সম্বোধন করে থাকে।
ত্রিপিটকে দেখা যায় একদা ভগবান সম্যক
সম্বুদ্ধ এক ব্রাহ্মণ গ্রামে ভিক্ষাচরণে গিয়েছিলেন। সেখানে এক ব্রাহ্মণ তাকে
পুত্র সম্বোধন করে জড়িয়ে ধরে বাড়ীতে নিয়ে যান। আপন পুত্রকে যেভাবে আদর করে
খাওয়ান হয় সেভাবে ভগবান বুদ্ধকেও খাওয়ালেন। কেহ কেহ মনে করল ব্রাহ্মণের মতিভ্রম
হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ দেশনায় বলেন- এ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ঠিকই বলেছেন। তিনি পূর্ব
জন্মে আমার বাবা ছিলেন। পূর্ব সংস্কার বশতঃ তিনি আমাকে পুত্র সম্বোধন করেছেন। ভগবান
বুদ্ধের অমৃতময় বিভিন্ন ধর্মদেশনা শুনে উক্ত ব্রাহ্মণ মার্গফল লাভ করেন এবং সঙ্গে
সঙ্গেই জাতিস্মর জ্ঞান লাভ করে পূর্বজন্মের পিতা পুত্রের প্রমাণ পেলেন।
আর এক ব্যক্তিক্রমধর্মী বাবাও পুত্রের গভীর
সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠক পাঠিকাদের সমীপে ব্যক্ত করছি। গতবার (১৯৯১ইংরেজী) শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তে খাগড়াছড়ি জেলায়। ছাব্বিশ দিনের জন্য এক ধর্ম অভিযাত্রায় পরিভ্রমণ
করেন। বিভিন্ন স্থানে ধর্ম সভা করার জন্য সেই অঞ্চলের মাননীয় ব্রিগেড কমান্ডার
মহাহোদয় একখানা গাড়ীর ব্যবস্থা করে দেন। বন ভন্তেকে সযত্নে গাড়ীতে উঠানামা করার
জন্য একজন সৈনিককে দায়িত্বভার অর্পণ করেন। আনুমানিক ২২/২৩ বৎসরের অবিবাহিত যুবক,
দেখতে নাদুস-নুদুস আদুরে চেহারা। সেবাকার্যে বেশ যত্নশীল, ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত
আছেন।
কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন স্থানে ধর্মসভায় যোগদান
করার পর উক্ত ক্যাপ্টেন একটু হেসে বন ভন্তের প্রতি কিছু বলবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।
বন ভন্তেঃ কিছু বলতে চান?
ক্যাপ্টেনঃ হ্যা।
বন ভন্তেঃ বলতে পারেন।
ক্যাপ্টেনঃ আপনার সংস্পর্শে এসে আমি খুবই
আনন্দিত এবং নিজকে অতীব ধন্য বলে মনে করি।
বন ভন্তেঃ কেন?
ক্যাপ্টেনঃ আপনার কথাগুলি আমার খুবই ভাল
লাগে। যদি কিছু মনে না করেন। একটা কথা বলতে পারি।
বন ভন্তেঃ (চিত্তের অবস্থা জেনে) বলতে পার।
ক্যাপ্টেনঃ আপনাকে বাবা ডাকতে ইচ্ছে হয়।
বন ভন্তেঃ কেন? তোমার বাবা নেই?
ক্যাপ্টেনঃ আছে।
বন ভন্তেঃ তবে কেন ডাকবে?
ক্যাপ্টেনঃ আমার মন যে চায় আপনাকে বাবা
ডাকতে।
বন ভন্তেঃ আমি বৃদ্ধ হয়েছি, সেজন্য?
ক্যাপ্টেনঃ না, একান্ত ইচ্ছার কারণে।
বন ভন্তেঃ বাবা ডাকলে বাবা ও পুত্রের গুরুত্ব
দিতে হয় জান?
ক্যাপ্টেনঃ অনুগ্রহ পূর্বক গুরুত্ব সম্বন্ধে
একটু বলুন।
বন ভন্তেঃ তাহলে মন দিয়ে শুন, ধারণ কর এবং
আচরণ করতে চেষ্টা কর। বাবা পুত্রের অমঙ্গল চায়না। সব সময় মঙ্গল কামনাই করে। তাই
দায়িত্ব ও কর্তব্যের কারণে প্রকাশ করছি।
১। আমার মত বয়সের লোক দেখলে মনে করবে তোমার
বাবার মত।
২। তোমার মত বয়সের লোক দেখলে মনে করবে আপন
ভাই এর মত। শক্র বা অপর মনে করবেনা।
৩। যুবতী নারী আপন বোনের মত মনে করবে। চিত্তে
কোন সময় কামভাব উৎপন্ন করবেনা।
৪। যে কোন বয়সের নারী পুরুষ দেখলে আপন
ব্যতীত অপর মনে করবেনা।
৫। কারো প্রতি হিংসা, ঘৃণা ও অবজ্ঞা সূচক ভাব
মনে স্থান দিও না। সকলের প্রতি মৈত্রী ভাব পোষণ করবে।
এ পাঁচটি উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে
চেষ্টা কর। তুমি বাংলাদেশের যেখানে যাওনা কেন সেখানে পাচটি উপদেশ মেনে চলিও। তোমার
মনের শান্তি ও অনাবিল সুখ বহে আসবে। মানুষের মনের শান্তি ও সুখ খুব বড় সম্পদ “ধর্ম বাবা” যখন ডেকেছ, উপদেশ পালনে
যথাযথ মূল্য দিও।
পরিশেষে উভয়ের মধ্যে বিদায় নেয়ার পালা।
পুত্র সজল নয়নে ও করুণ স্বরে বললেন-বাবা আমাকে আশীর্বাদ করবেন। বাবাও অনাসক্ত
ভাবে বললেন-তুমি শান্তিতে খাক ও সুখে খাক আশীর্বাদ করি কিন্তু আমার উপদেশগুলি পালন
করবে।

বনভন্তের সংক্ষিপ্ত উপদেশ
গুচ্ছ
সাধারণতঃ উচ্চ মার্গের উপদেশ
সাধারণ উপাসক-উপাসিকারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনা। অপেক্ষাকৃত সহজভাবে প্রকাশিত হলে
সকলে ঐ সকল উপদেশাবলীর মর্মার্থ। উপলব্ধি করে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের কথিত উপদেশসমূহ
পালনে ব্রতী হতে পারেন।
প্রায় সময় লক্ষ্য করা যায় শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তে ভিক্ষু-শ্রমণ, উপাসক-উপাসিকা অথবা যে কোন ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করে অতি
সংক্ষেপে উপদেশ দিয়ে থাকেন। তাঁর উপদেশাবলী গভীর তথ্যমূলক, মুক্তির পথ নির্দেশক ও
ব্যাপক ভাবার্থে পরিপূর্ণ। যারা এগুলি বুঝার ক্ষমতা অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেছেন
শুধু তারাই বুঝতে পারেন। স্বল্প জ্ঞানীরা বিশদ বিশ্লেষণ ব্যতীত বুঝতে সক্ষম হন না।
প্রত্যেকটি উপদেশ পুংখানুপুংখ রূপে ব্যাখ্যা বা ভাবসম্প্রসারণ করলে এক একটির কলেবর
পুস্তক আকারে প্রকাশ পাবে।
সুতরাং পাঠক-পাঠিকাদের জানার সুবিধার্থে
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের নিকট হতে শ্রুত মহামূল্য উপদেশ সমূহ সযত্নে চয়ন করে "বন
ভন্তের সংক্ষিপ্ত উপদেশ গুচ্ছ” নামে কিছু উপদেশাবলী প্রকাশ করতে চেষ্টা করছি।
পাঠক-পাঠিকারা শদ্ধেয় বন ভন্তের সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ জানতে পারলেও আমার পরিশ্রম
সার্থক হয়েছে মনে করবো। বন
ভন্তের
দেশনা হতে যে সকল মূল্যবান উপদেশ সংক্ষিপ্ত আকারে চয়ন করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ-
১। ত্যাগই
সুখ, ভোগই দুঃখ ।।
২। জীবন
যাপনে বাতাসের মত আশ্রয়হীন ভাব অবলম্বন কর।
৩। সর্ব
বিষয়ে অনাসক্ত হও।
৪। শীল রূপ
কাপড় পরিধান কর।
৫। অজ্ঞান
মিথ্যা ত্যাগ করতে পারলে জ্ঞান সত্য পাওয়া যায়।
৬। তুমি
এমন জায়গায় যাও যেখানে যাবে মারে দেখবেনা।
৭। ধর্মের
অধীন ও কর্মের অধীন থাকিও না।
৮। বিপদের
সময় প্রকাশ পায় কার কতটুকু জ্ঞানের পরিধি আছে।
৯। কায়,
রূপ ও অরূপ ত্যাগ কর।
১০।
কুশল কর্মে তুমি মুনি হও।
১১।
শীল পালনকারীকে সাধু বলে।
১২।
দয়া, ক্ষমাশীল, পূণ্য কর্মে নির্ভীক,
সহিঞ্চ ও মৈত্রী পারায়ণ লোককে পন্ডিত বলে।
১৩।
ত্রিলোক দুঃখ, মিথ্যা ও অগ্নিকুন্ড তুল্য।
১৪।
চিত্তের নির্মলতা, উচ্চ ও উচ্চ মনই
মুক্তির সোপান।
১৫।
দান কর ভোগের উদ্দেশ্যে নয়, মুক্তির
উদ্দেশ্যে।
১৬।
যে সুখী হতে চায় তার পক্ষে একা থাকা ভাল।
১৭।
শুধু কাষায় বস্ত্র পরিধান ও মস্তক মুন্ডন
করলে ভিক্ষু হয়না।
১৮।
অজ্ঞানতা বশতঃ পৃথিবী ভ্রমণ করলেও কোন
শান্তি নেই, সুখ নেই ও শ্রম
বৃথা।
১৯।
বনের বাঘকে ভয় করনা, নারীকে ভয় কর।
২০।
মার্গ ভাবনায় মুক্ত হও।
২১।
চিন্তা ভাবনায় আকাশের মত উদার হও।
২২।
জীবন ও মনুষ্য সুখ ত্যাগ কর, নিবৃত্তি সুখ
গ্রহণ কর ও নির্বাণ সুখ গবেষণা কর।
২৩।
শ্রদ্ধা, স্মৃতি, একাগ্রতা ও প্রজ্ঞায়
পারদর্শী হও।
২৪।
পূর্বে সঞ্চিত পূণ্য, ইহজন্মের প্রচেষ্টাও
বুদ্ধের উপদেশে ভব সাগর পার হওয়া যায়।
২৫।
প্রত্যেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা কর।
২৬।
তুমি নির্বাণ পুকুরে স্নান কর।
২৭।
কর্মযোগে অসাধারণ হও।
২৮।
চারি মার্গ সত্য কথন, দেশনা প্রজ্ঞাপন,
প্রকাশন ও স্থাপন কর।
২৯।
এম, এ, পাশ ও ত্রিপিটক বিশারদ হলে শিক্ষিত
বলা যায় না। বুদ্ধ জ্ঞানে
শিক্ষিত
হও।
৩০।
মার্গফল লাভীই প্রকৃত বিশ্বাসী।
৩১।
সৎ পুরুষ দর্শন, সদ্ধর্ম শ্রবণ,
প্রনালীবদ্ধ চিন্তা ধারা ও সদ্ধর্ম আচরণই ইহ
জন্মে
প্রশংসিত হয়।
৩২।
ইন্দ্রিয় দমন, আত্ম দমন ও চিত্ত দমনই
প্রকৃত দমন।
৩৩।
দেহে কৃশ হও ও জ্ঞানে প্রদীপ্ত হও।
৩৪।
মুক্তির জন্যে সংগ্রাম কর।
৩৫।
নিজের জন্ম নিজে নিয়ন্ত্রণ কর।
৩৬।
সকল বস্তুতে দুঃখ, মিথ্যা ও পাপ দেখে
আসক্তি বর্জন কর।
৩৭।
নিজে মুক্ত হয়ে অপরকে মুক্ত কর।
৩৮।
অবিদ্যার অন্ধকার থেকে নির্বাণ আলোকে আস।
৩৯।
নির্বাণই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়।
৪০।
তোমার সব কিছু আছে, কিন্তু কোন কিছু নেই
হিসাবে জানতে হবে।
৪১।
জ্ঞান আর সত্য উদয় হলে অবিদ্যা তৃষ্ণা ধ্বংস হয়।
৪২।
অনুবীক্ষণ যন্ত্রে যেমন ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র
জিনিস দেখা যায় সেরকম তোমাদের অসংখ্য
দুঃখরাশি
আমি নিরীক্ষণ করি।
৪৩।
দেব ব্রহ্মরাও হীন এবং মিথ্যা।
৪৪।
কাম সুখ অন্তে দুঃখ।
৪৫।
পঞ্চ স্কন্ধের বিলয় ঘটাও।
৪৬।
পরধর্ম,(লোভে, দ্বেষ,মোহ, দুঃখ)সদ্ধর্ম
(শীল, সমাধি প্রজ্ঞা) সুখ।
৪৭। অন্য পথে চলিও না, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ পথে
চল।
৪৮।
তুমি শূণ্যের দিকে চেয়ে থাক।
৪৯।
তৃষ্ণাস্রোত অতিক্রম কর।
৫০।
জন্ম-মৃত্যু বন্ধ কর।
৫১।
লৌকিক সুখ-দুঃখ অতিক্রম কর।
৫২।
নির্বাণ দর্শনই যথার্থ দর্শন।
৫৩।
সর্বদা নিজেকে অক্ষুন্ন রাখ।
৫৪।
দুর্বলের স্বর্গ কামনা সবলের নির্বাণ
কামনা।
৫৫।
হীন সংস্কার ও হীন মনুষ্যত্ব ত্যাগ কর।
৫৬।
কাম সুখ ও আত্মপীড়ন ত্যাগ কর।
৫৭।
নির্বাণের নিকট আত্ম সমর্পণ কর।
৫৮।
কোথায় পাব? কে দেবে? কি খাব? আমার বিছানা
কোথায়? এচিন্তা করিও না। (শিষ্যদের)
৫৯। জ্ঞানীরা ধন,জন,পদ,রোগ মুক্তি এমন কি আপন
সমৃদ্ধির জন্যও কামনাকরেননা।
৬০।
অন্তর্দষ্টি ভাব উৎপন্ন কর।
৬১।
অপরের প্রতি পালক হইওনা।
৬২।
জাতি বাদ উচ্ছেদ কর।
৬৩।
নয় প্রকার মান ধ্বংস কর।
৬৪।
অজ্ঞানতা হতে সকল দঃখের উৎপত্তি।
৬৫।
অবিদ্যা নিরোধ করে বিদ্যা বা প্রজ্ঞা
উৎপন্ন কর ও চিত্তের গতি নিরোধ কর।
৬৬।
অগ্রত্বে শ্রেষ্ঠত্ব হয়। হীনত্বে অগ্রত্ব
হয়না।
৬৭।
মেঘ চন্দ্র সূর্যের ন্যায় স্থায়ী নয়,
মিথ্যা ও সত্যের ন্যায় স্থায়ী নয়।
৬৮।
তোমরা নিরানব্বই ভাগ দুঃখের বোঝা বহন করে
মাত্র একভাগ সুখ পেয়ে
আনন্দ
কর।
৬৯।
যিনি নির্বাণের স্বাদ পেয়েছেন তাঁকে কোটি
কোটি টাকার সম্পদ দিলেও অতি
তুচ্ছ
মনে করেন।
৭০।
জ্ঞান দান, ধর্ম দান ও অভয় দানই উত্তম
দান।
৭১।
ইহ জীবনকে তুচ্ছ মনে করে শীল পালন করে মরে
যাও।
৭২।
ধানক্ষেতের মাঝখানে খালি জায়গায় গরু
চড়ানো যেমন মহাকষ্টকর তেমনি
দুঃশীলের
মাঝে শীল পালন করাও মহাকষ্টকর।
৭৩।
মার্গসুখ, ফলসুখ ও নির্বাণ সুখই উত্তম সুখ।
৭৪।
প্রাণীর মধ্যে যেমন তিমি মাছ সর্ববৃহৎ,
তেমনি মানুষের মধ্যে মার্গফল লাভাই
শ্রেষ্ঠ।
৭৫।
তুমি যা পাও তাতেই সন্তুষ্ট থাক।
৭৬।
যারা হীন ও সাধারণ ব্যক্তি তারা সংসারে
নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত থাকে।
৭৭।
যিনি চারি আর্যসত্যকে দর্শন করেছেন তিনি
বুদ্ধকে দর্শন করেছেন।
৭৮।
মানবিক চাপ, বিদ্বেষ ও উত্তেজনা হতে পাপ ও
দুঃখ উৎপত্তি হয়।
৭৯।
জ্ঞান আর সত্য দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়।
৮০।
নিজের এবং অপরের মঙ্গল ও সুখের জন্য কথা
বল ও কাজ কর।
৮১।
জ্ঞান পূণ্যে ভেজাল দিওনা।
৮২।
সমাজের নানাবিধ কাজ ও রাজনীতি ভিক্ষুর
কর্ম নয়।
৮৩।
দুঃখেও থাকিওনা, সুখেও থাকিও না।
৮৪।
দেহ মূর্তি ধারণ করলে সংসার অতিক্রম করা
যায়না।
৮৫।
জ্ঞানের দ্বারা যে সুখ উৎপন্ন হয়, সে
সুখই প্রকৃত সুখ।
৮৬।
তৃষ্ণা, মিথ্যা দৃষ্টি ও অহংকার মানুষের
পরিহানি ঘটায়।
৮৭।
তৃষ্ণারূপ সাগরে নির্বাণরূপ দ্বীপে আশ্রয়
লও।
৮৮।
দেখলে দেখতে পার শুনলে শুনতে পার ও অনুমান
করলে অনুমান করতে পার।
কিন্তু
আসক্ত হবেনা।
৮৯।
সংসারে থেকে সংসারের নানাবিধ বিষয়ে লিপ্ত
না হয়ে জীবন অতিবাহিত কর।
৯০।
নারী বা পুরুষ নয়, চারি মহাভূত হিসাবে
দর্শন কর।
৯১।
তুমি কোথায় যাবে গন্তব্য স্থল ঠিক কর।
৯২।
এ সংসারে যাবতীয় সুখ তুচ্ছ মনে কর ও ভোগ
কামনা ত্যাগ কর।
৯৩।
পঞ্চমার জয় কর।
৯৪।
ত্রিহেতুক লোকই মুক্ত হতে পারে।
৯৫।
পৃথিবী হতে চন্দ্র-সূর্য যেমন বহু দুরে
অবস্থান করে তেমন সদ্ধর্ম হতে সাধারণ
ব্যক্তির
অবস্থান বহু দূরে।
৯৬।
নবলোকোত্তর ধর্মের অধিকারী হও।
৯৭।
অন্যায়, অপরাধ, ভূল ও গলদ করিও না।
৯৮। শ্রদ্ধা হতে মনুষ্য সম্পত্তি, দেবসম্পত্তি ও
নির্বাণ সম্পত্তি উৎপত্তি হয়।
৯৯। যার যতটুকু সামর্থ তার ততটুকু ত্যাগ, যার
যতটুকু ত্যাগ, তার ততটুকু মুক্তি।
১০০।
নহে দূরে নহে কাছে খুঁজলেই পায়।
লোভ-দ্বেষ-মোহ তাকে ঢাকিয়াছে গায়।

চির শান্ত হবে তুমি রহিবে অম্লান।।
নির্বাণ কোথায়?
নির্বাণ কোথায়? এটা একটা জটিল প্রশ্ন। নির্বাণ যিনি
উপলব্ধি বা লাভ করেছেন তিনিই ভালভাবে সমাধান দিতে পারেন। যিনি লন্ডনে গিয়েছেন
তিনি লন্ডন সম্বন্ধে পুংখানুপুংখরূপে বিবরণ দিতে সক্ষম হবেন। যিনি লন্ডনে যান নি
তিনি অপরের মুখে বা বই পুস্তক থেকে পড়ে লন্ডন সম্বন্ধে বলতে পারেন। এখানে কথা
হচ্ছে যে, লন্ডনে যিনি সশরীরে গিয়েছেন আর যিনি অপর লোক থেকে বা বই পুস্তক থেকে
পড়ে দেখেছেন তাতে অভিজ্ঞতায় অনেক ব্যবধান থাকবে। যাঁরা ত্রিপিটক অধ্যয়ন করে
নির্বাণ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেন,তাঁদের মধ্যেও অভিজ্ঞতায় বা বর্ণনায় অনেক ব্যবধান
থাকবে।
একদিন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের নিকট জনৈক উপাসক জিজ্ঞাসা
করেছিলেল-ভন্তে, নির্বাণ কোথায়? বন ভন্তে বলেন-নির্বাণ স্বর্গে, ব্রহ্মলোকে বা
অন্য কোথাও নহে। তাহা পঞ্চ ইন্দ্রিয়েও জানা যায়না। তাহা মনো ইন্দ্রিয়ে জানা
যায়। যাঁর মন বা চিত্ত নির্বাণ সম্বন্ধে জানার ক্ষমতা অর্জন করবে তিনিই নির্বাণ
সম্বন্ধে জানতে পারবেন।
বন ভন্তে উপমা দিয়ে বললেন- 'ধর, আমি একটা মুরগীর বাচ্চাকে বিভিন্ন
স্থানে। নিয়ে বলি –এটা
চট্টগ্রাম, এটা ঢাকা, এটা কলিকাতা প্রভৃতি। মুরগীর বাচ্চাটি কি বুঝতে পারবে ঐ
সমস্ত স্থান সম্বন্ধে? উপাসক বলল – না ভন্তে, ভন্তে বললেন-ঠিক তুমিও মুরগীর বাচ্চার মত।
উপলব্ধি না হলে নির্বাণ কি বা কোথায় বলে বুঝতে পারবেনা।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে অন্য উপমায় বললেন-ধর, তুমি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কর। যদি কেহ তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্বন্ধে পাঠ দান
করেন, তবে তুমি কি তা বুঝতে পারবে? উপাসক বলনা ভন্তে, বনভন্তে বলেন- সেরূপ তুমিও
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে বুঝতে পারবেনা, তুমি ক্রমান্বয়ে জ্ঞান লাভ কর
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কর। নিশ্বয়ই এম, এ, ক্লাশের পাঠ সম্বন্ধে বুঝতে পারবে।
নির্বাণের বেলায়ও একই ব্যাপার।
একদিন বাবু বিদ্যুৎ কুমার তালুকদার সহ আমি বন বিহার হতে আসার সময়
নদীর ঘাটে জনৈক উপাসিকার সাথে দেখা হয়। বিদ্যুৎ বাবুর সাথে উক্ত উপাসিকার কুশল
বিনিময়ের পর বিদ্যুৎ বাবু বলেন-লঞ্চ ধর্মঘটের কারণে চাকুরীতে (মারিশ্যায়)।যোগদান
করতে পাচ্ছিনা। উক্ত উপাসিকা তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন-আপনার কোথাও যাওয়ার দরকার
নেই। আপনি নির্বাণে চলে যান। এই কথা বলার পর আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। আমার সাথে
সাথে আরো কয়েকজন হেসে ফেলেন। তাতে উপাসিকা হতবাক হয়ে বন বিহারে চলে গেলেন। নদী
পারাপার হওয়ার সময় আমরা (নৌকার যাত্রী) উপাসিকার উক্তি সম্বন্ধে মন্তব্য করে
বললাম-বিদ্যুৎ বাবু ভুল করেছেন, নির্বাণের ঠিকানাটি তার থেকে জেনে নেওয়া উচিৎ
ছিল। শেষ মন্তব্যে আরো বললাম-উপাসিকার মতে নির্বাণ কোন এক নিরাপদ জায়গা হতে পারে।
উক্তউপাসিকার মত অনেকে এ রকম ধারণা করে থাকেন।
নির্বাণ বৌদ্ধদের চরম ও পরম
লক্ষ্য। কিন্তু অনেকে ভুল পথে পরিচলিত হন। এ রকম ভুল তথ্য পোষণকারীর দুটি তথ্য
গল্পাকারে নিয়ে ব্যক্ত করছি।
১। কোন এক বিহারের পাশেই এক উপাসিকার ঘর। প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা
বিহারে গিয়ে নিয়মিত উপাসনাদি করে দিনের বেলায় নাতি-নাতনীর রক্ষণাবেক্ষণই উক্ত
উপাসিকার প্রধান কাজ। একদিন সেই উপাসিকা বন্দনাদি করার পর বুদ্ধের সামনে। এভাবে
প্রার্থনা করলেন-হে করুণার আধার ভগবান বুদ্ধ, তুমি আমাকে নির্বাণে নিয়ে যাও।
জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে আমি অতিকষ্টে কালযাপন করছি। এ পৃথিবীতে থাকার আমার আর ইচ্ছা
নেই। অতি সত্বর আমাকে নির্বাণে নিয়ে যাও।
সে বিহারে বিহারাধ্যক্ষ জনৈক পন্ডিত ভিক্ষু উপাসিকার প্রার্থনা
শুনে সংশোধন করার চেষ্টা করেও বিফল হন। আর একদিন তিনি বুদ্ধ মূর্তির আড়ালে থেকে
বললেনহে উপাসিকা, তুমি প্রস্তুত হও। তোমাকে নির্বাণে নিয়ে যাব। এদিকে উপাসিকা মনে
মনে ধারণা করলেন—ঠিকই
স্বয়ং বুদ্ধই আমাকে বলেছেন। আর একদিন প্রার্থনার পর উক্ত পন্ডিত ভিক্ষু বলেন-এখন
সময় হয়েছে, কখন নির্বাণে যাবে বল? উপাসিকা চোখ বন্ধ অবস্থায় বলেন-প্রভূ, আমি
এখনও প্রস্তুত হতে পারিনি, কারণ আমার ছোট নাতিটি আমাকে ছাড়া থাকেনা। তদুপরি তার
প্রতি মায়ামমতায় জড়িয়ে পড়েছি। সে আর একটু বড় হোক। উপযুক্ত হলে নির্বাণে যাব।
বহুদিন হয়ে গেল উপাসিকার উপযুক্ত সময় হলনা। আর একদিন উপযুক্ত
সময় পেলেন সেই পন্ডিত ভিক্ষু। সমবেত উপাসক উপাসিকাদেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা
করলেন-কে কে নির্বাণে যাওয়ার ইচ্ছা কর। হাত তোল। প্রথমেই হাত তোললেন-সেই উপাসিকা।
পন্ডিত ভিক্ষু বললেন- আর কারো হাত তোলার প্রয়োজন নেই। যার জন্যে আয়োজন করেছি, সে
প্রথমেই হাত তুলেছে। তারপর উক্ত ভিক্ষু উপাসিকার প্রার্থনা ও তার বিচক্ষণতার কথা
প্রকাশ করে বলেন-নির্বাণই পরম সুখ। নির্বাণ কোথাও নয়। নির্বাণ উপযুক্ত চিত্তেই
অনুভব করা যায়। যেমন বাতাস যে আছে, তার প্রমাণ শরীর দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি
সেরূপ নির্বাণও আছে। পরম পূণ্যবান ব্যক্তিই কেবল নির্বাণ উপলব্ধি করতে পারেন।
২। বহুদিন আগের কথা। কোন এক দেশে এক রাজা রাজত্ব করতেন। পৌঢ় বয়সে
তিনি ধর্মানুরাগী হন। ধর্মালোচনাতে তিনি আনন্দ পেতেন। সে দেশের এক বিখ্যাত
পন্ডিতের সাথে তার সখ্যতা জন্মে। তিনি মনে করতেন সে দেশে শুধু উক্ত পন্ডিতই মুক্ত
পুরুষ। একদিন রাজা আলোচনা প্রসঙ্গে পন্ডিতকে বলেন-আপনিই আমার একমাত্র মুক্তিদাতা।
আপনি ছাড়া আমাকে কেহ মুক্তি দিতে পারবে না অনুগ্রহ পূর্বক আমাকে মুক্ত করে দিন।
পন্ডিত মশাই বললেন-আপনি যা ধারণা করছেন তা ভুল ধারণা। আমি মুক্ত পুরুষ নই। শুধু
পন্ডিতই বটে আপনাকে মুক্ত করার সাধ্য নেই। তবুও রাজা পন্ডিত মশাইকে বারবার অনুরোধ
করে বলেন-ঠিক আছে, আপনি কিছুদিন চিন্তা করে সমাধান দিলে ভাল হয়।
এদিকে রাজার সমাধান দিতে গিয়ে পন্ডিত মশাই এর রীতিমত পেটের ভাত ও
চোখের ঘুম চলে গেছে। এমন কি রাজার চিন্তায় চিন্তায় পান্ডিত্যের পরিধি পর্যন্ত
খর্ব হয়ে যাচ্ছে। তা দেখে তাঁর ছেলে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল-ইহার কারণ কি?
পন্ডিত মশাই তার ছেলেকে সমস্ত বিষয়টি প্রকাশ করার পর ছেলে বলল-চিন্তার কোন কারণ
নেই। আপনি রাজাকে সংবাদ দিন। আমি নিজেই উহার উপযুক্ত সমাধান দিতে সক্ষম।
একদিন পন্ডিত মশাই তাঁর ছেলেকে নিয়ে রাজার নিকট উপস্থিত হলেন।
রাজা। মহাশয় উৎফুল্ল চিত্তে চিজ্ঞাসা করলেন- এখন আমার কি করতে হবে বলুন। পন্ডিত
পুত্র বলল–আপনার
কিছু করতে হবেনা। একটা মাহুত ছাড়া হাতী এখানে নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিন। অতঃপর
রাজা পন্ডিত ও পন্ডিত পুত্রকে নিয়ে ঐ হাতীর পিঠে চড়ে তাঁরা গহীন অরণ্যের দিকে
চলে গেলেন। সুবিধামত দু’টা
গাছ দেখে তাঁরা সেখানে নেমে পড়লেন। রাজা এবং পন্ডিতকে দুই গাছের গোড়ায় সামনা
সামনি দাঁড় করানো হলো। পন্ডিত পুত্র তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি শর্ত দিয়ে
বল্ল-আমি যা করি বা যা বলি তা দ্ব্যর্থহীন ভাবে মেনে নিতে হবে। তারা উভয়ে সম্মতি
জ্ঞাপন করার পর পন্ডিত, পুত্র তার পকেট থেকে দুটো রশি বের করলো। প্রথমেই তার
বাবাকে ও পরে রাজাকে ভালভাবে গাছের সাথে বেঁধে ফেললো। অবশেষে একটু দূরে দাঁড়িয়ে
বলল বাবা, আপনি রাজা মহাশয়কে মুক্ত করুন। আমি চলে যাচ্ছি। পন্ডিত পুত্র হাতীর
পিঠে করে অপেক্ষমান জনগণের নিকট খবর দিল–আপনারা সবাই এসে দেখে যান আমার বাবা এবং রাজার অবস্থা
খুব খারাপ। জনগণ দুইজনকে বন্ধন অবস্থায় দেখে বলল-এ কি ব্যাপার? পন্ডিত পুত্র বল্ল-অনুগ্রহ
পূর্বক তাদের কে কেউ খুলবেন না শুধু দেখতে পারবেন। পরিশেষে রাজা হেসে হেসে
বললেন-বুঝতে পেরেছি, পন্ডিত পুত্র মহাপন্ডিত। পন্ডিত পুত্র এ ঘটনা না ঘটালে আমার এ
ভুল জীবনে কোনদিন সংশোধন হতোনা।
তা হলে বুঝা যায়, যে মুক্ত নয় সে কখনও অপরকে মুক্ত করতে পারেন।
সেরূপ। শ্রদ্ধেয় বনভন্তে প্রায়ই ধর্মদেশনায় বলে থাকেন-তোমাদের হাত পা শক্ত ভাবে
বাঁধা। আছে। কার কাছে জান? যেমন অবিদ্যা, তৃষ্ণা,লোভ, দ্বেষ,মোহ, আসক্তি, মান,
সন্দেহ, মিথ্যা দৃষ্টি, শীলব্রত পরমাশ, তন্দ্রা-আলস্য এবং বিভিন্ন ক্লেশের নিকট।
এগুলি হল রশি সদৃশ। কোন কারাগারে আছ জান? যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রীপুত্র,
বন্ধু-বান্ধব, জ্ঞাতি-মিত্র, দেশ-গ্রাম, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিষয়-সম্পত্তি এবং
বিভিন্ন প্রভুত্বের কারাগারে আছে। যতদিন পর্যন্ত উপরিল্লিখিত রশি এবং কারাগার থেকে
মুক্তি পাবেনা ততদিন পর্যন্ত কখনো নিজেও মুক্ত হতে পারবেনা এবং অপরকেও মুক্ত করতে
পারবেনা। যেমন একজন লোকের রোগ হয়েছে। সে রোগের কারণ নিশ্চয়ই থাকবে। আবার দেখা
যায় রোগ হলে সে রোগের ঔষধ বা উপায় নিশ্চয়ই থাকবে। উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ করলে সে রোগ
সেরে যায়। সে রকম দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের
পথও আছে। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই দুঃখ নিরারোধের একমাত্র পথ। সে পথ দিয়ে অনার্য
বা অজ্ঞানীরা চলতেপারে না আর্য হয়ে চলতে হয়। সে পথ হল শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা।
সম্যক শীল বলতে সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যাক আজীব বা জীবিকাকে
বুজায়সমাধি বলতে সম্যক স্মৃতি সম্যধ্যায়াম বা উদ্যম ও সম্যক সমাধিকে
বুঝায়াপ্রজ্ঞা বলতে সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্পকে বুঝায়। এ আটটির সমন্বয়ে
নির্বাণ লাভ করা যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সর্ব দুঃখের অবসান ও মুক্তি লাভ করা যায়।
যে মুক্ত ও বন্ধনহীন তিনি অপরকে অনায়াসে মুক্ত বা বন্ধন খুলে দিতে সমর্থ ইহাই
অবিনাশী বা পরম সুখ নির্বাণ।
নহে
দূরে নহে কাছে খুজলেই পায়।
তার
লোভ-দ্বেষ-মোহ তাকে ঢাকিয়াছে গায় ।।
আরবরণ
খুলে ফেল দেখিবে নির্বাণ।
চির
শান্ত হবে তুমি রহিবে অম্লান।
বন ভন্তে কি অর্হৎ?
মহান সাধক শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বন ভন্তে) মহোদয়
প্রায় ৪২ বৎসর যাবৎ শমথ-বিদর্শন ধ্যান সাধনা অনুশীলন করে আসতেছেন। তিনি সাধনা করে
আনন্দ পান বলেই তার নাম সাধনানন্দ নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম জীবনে তিনি গভীর ও
নির্জন বনে কঠোর ধ্যান সমাধিতে মগ্ন থাকতেন বলে লোকেরা তাঁকে বনভন্তে নামে
আখ্যায়িত করেছেন।
এখন অনক ভিক্ষু-শ্রমণ ও উপাসক-উপাসিকাদের মনে একটা প্রশ্ন জাগে
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে অর্হত্ব লাভ করেছেন কিনা? আমাকেও অনেকে এরূপ প্রশ্ন করেছেন।
একবার জনৈক পন্ডিত ভিক্ষু আমাকে প্রশ্ন করলেন-বন ভন্তে কি অহৎ? এই প্রশ্নটি করার
সাথে সাথেই আমার মনে রাগ উদয় হলো কারণ প্রশ্নটি কেমন একটা হাস্যস্পদ ধরনের। আমি
মনে মনে রাগ সংবরণ করে প্রশ্নের উত্তর দিতে উদ্যত হলে তিনি অন্য প্রশ্ন করেন আমার
উত্তর শুনতে চান না। তাতে আমি দৃঢ় ভাবে বলাম-আপনি কি উত্তর শুনতে চান? নাকি হাসি
ঠাট্টা করতে চান? দু’টার
থেকে একটা বলুন। পরিশেষে তিনি বলেন-উত্তর শুনতে চাই।
প্রথমেই আমি বললাম আমার যৎ সামান্য জ্ঞান নিয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট
করতে পারবো বলে আমি আশা করিনা, যা হউক, শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সংস্পর্শে এসে যেটুকু
বন ভন্তের সম্বন্ধে আমি উপলব্ধি করেছি, তা প্রকাশ করতে পারি। বনভন্তে অহৎ এই............................................................................................................................................................... আর একদিন জনৈক পাপাচার ভিক্ষু (জয়পাল)
সম্বন্ধে মন্তব্য করে ভন্তে বলেনসেছিল বিরাট কায়া বিশিষ্ট অজগর সাপ। তিনি
বিশ্লেষণ করে বলেন-অজগর সাপ হরিণ কিভাবে ধরে জান? প্রথমে তার লেজ দ্বারা আমলকি
গুলি জড়ো করে। দ্বিতীয়তঃ জংগল হতে মুখে পাতা সংগ্রহ করে আমলকির স্তুপ পর্যন্ত
সারিবদ্ধভাবে পাত সাজিয়ে রাখে তৃতীয়তঃ জঙ্গল হতে পাতার ভিতর দিয়ে আমলকির স্তুপ
পর্যন্ত এসে ওত পেতে থাকে। যখনই হরিণ আমলকি খাওয়া আরম্ভ করে তখনই হঠাৎ হরিণটিকে
গিলে ফেলে। সে রকম উক্ত ভিক্ষু হল সেই অজগর, তার রং বস্ত্র হল পাতা, যুবতী নারী হল
হরিণ, বিহার হল আমলকি গাছ এবং বিভিন্ন পুণ্যানুষ্ঠান হল সেই আমলকি। বন ভন্তে
অজগরের কীর্ত্তি কাণ্ডের কথা বলার সাথে সাথে উপাসক-উপাসিকাদের মধ্যে হাসির শোরগোল
পড়ে যায়। তারপর শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে সিংহ চর্মজাতক দেশনা করে বলেন-পাপাচার
ভিক্ষুরাই যতসব ধর্মের পরিহানি ঘটায়। তারা অতীব হীন অধম ও মূর্খ হিসাবে গণ্য হয়।
আর একদিন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে দেশনা প্রসঙ্গে বলেন-উপাসক-উপাসিকারা
ফান্টা, কোকাকোলা পানিয় হিসাবে দান করে। কিন্তু বোতল কেহ দান করে না। বোতল
কোম্পানীর নিকট ফেরৎ দিয়ে দেয়। আমরাও পানীয়রূপে গ্রহণ করে থাকি কিন্তু, অনেক
পাপাচার ভিক্ষু বোতলের প্রতি লোভ বা আসক্ত হয়ে আত্মসাৎ করে। তিনি বিশ্লেষণ করে
বলেন- ফান্টা-কোকাকোলা হল যাবতীয় দানীয় সামগ্রী এবং বোতল হল সেই যুবতী নারী।
পাপাচার ভিক্ষুরা যুবতী নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে নানাবিধ দুঃখ এবং সমস্যার সৃষ্টি
করে।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে তাঁর শিষ্যদেরকে উপলক্ষ্য করে প্রায়শঃ বলে
থাকেন-তোমরা বনের বাঘকে ভয় করিও না. যুবতী নারীকে ভয় করিবে, কারণ বনের বাঘ তোমার
রক্ত মাংস খাবে আর যুবতী নারী খাবে তোমাদের জ্ঞান ও পূণ্য।
সুতরাং তোমরা নির্বাণের দিকে লক্ষ্য রেখে ধ্যান-সাধনা করে মুক্তি
লাভ কর, ইহাই আমার অনুশাষন। আর একদিন ভিক্ষুদের প্রতি লক্ষ্য করে শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তে বলেন-ভিক্ষুদের মধ্যে কেউ কেউ আমি কোন নিকায় বা দলে অথবা কোন ভিক্ষু।
সমিতিতে আছি তা জানার চেষ্টা করেন। উত্তরে আমি বলবো-আমি কোন নিকায়ে বা সমিতিতে
নেই বলেও ভুল হবে। বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন-কোথাও আছি বলে। ভব তৃষ্ণা হয়। অন্যদিকে
কোথাও নেই বলে দেখা যায় আমি আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান আছি। ভিক্ষু সংঘ দুই প্রকার।
যথাঃ সম্পত্তি সংঘ ও পরমার্থিক সংঘ। আমি পরমার্থিক সংঘেই আছি।
পরিশেষে ভিক্ষু সংঘের প্রতি উপদেশ দিয়ে বনবন্তে বলেন-যদি কেহ কাম লোক,
রূপ লোক, অরূপলোক, নিকায়ে বা সমিতিতে বিদ্যমান আছে বলে তাঁর মুক্তির পথ। সুগম
হবেনা। তা হলে কিভাবে থাকতে হবে জানেন? কাদায় উৎপন্ন পদ্ম নাল কাদয় লিপ্ত না
হয়ে যেভাবে থাকে সেভাবে কোন প্রকার নিকায় এর বা সমিতির কাদা না
যেখান থেকে যাত্রা
আবার সেখানে
রাজ
বন বিহার প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে এ পর্য্ন্ত শ্রদ্ধেয় বন ভান্তের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে
অনেক ভিক্ষু-শ্রমণ বন ভান্তের শিষ্যত্ত্ব গ্রহন করেছেন।কেহ কেহ দশ পনের দিন, কেহ কেহ
দুই তিন মাস পর্য্ন্ত প্রবজ্যা ধর্ম পালন করে চলে যান।অনেক সময় দেখা যায় তিন চার বৎসর
পর্য্ন্ত স্থায়ীত্ত্বের পর গৃহী ধর্মে ফিরে যান।
শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তের অনুশাসন হল এই-যে যতটুকু লেখাপড়া করেছে, তা যথেষ্ট।ভবিষ্যতে স্কুল কলেজে পড়বে
না। পঞ্চ ইন্দ্রিয় স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্য ভাল থাকলে চলবে। দিনে একবার মাত্র বা এগারটায়
অল্পহারে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমি কি খাব, কোথায় পাব ও আমার বিছানা কোথায় এ রকম বলতে
বা চিন্তা করতে পারবেনা। নতুন শ্রমণের ছোট খাট কাজ ও রাত দশটা থেকে রাত তিনটা পর্য্ন্ত
পালাক্রমে বিহার এলাকা পাহাড়া দিতে হবে। টাকা পয়সা ষ্পর্শ্ করতে পারবেনা। বিনা অনুমতিতে
বিহার এলাকা থেকে অন্যত্র যেতে পারবেনা। শুধু রাত এগারটা হতে রাত তিনটা পর্য্ন্ত ঘুমাতে
হবে। শীল ভঙ্গ অথবা বন বিহারের নিয়ম লংঘন করলে তাৎক্ষনিক ভাবে চলে যেতে হবে। প্রত্যেক
শ্রমণ ভিক্ষুদের শমথ-বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন করতে হবে।
উল্লেখিত নিয়মগুলি
হল শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের নিদের্শ নামার অর্ন্তগত। এখন আসল কথায় আসা যাক। বন বিহারে যে
হারে স্রোতের মত ভিক্ষু-শ্রমণ প্রবজ্যা-উপসম্পাদা লাভ করেন, আবার আবা সেহারেই চলে যান।
অর্থাৎ যেখানে থেকে যাত্রা আবার সেখানে ফিরে যান। প্রত্যেকের একটা জিজ্ঞাসা? আমার দৃষ্টিতে
নিম্নলিখিত কারণগুলি পরিলক্ষিত হয়ঃ-
১। পর্যাপ্ত পরিমাণ
খাদ্য অথবা ভাল ভাল খাদ্যের অভাবে চলে যায়। এদিকে বন ভন্তের নিদের্শ হল- তোমার সামনে
যা আসে, পেট ভর্তির পরিবর্তে অল্পহারে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
২। স্কুল কলেজে
অধ্যয়ন করার জন্য চলে যায়। এদিকে বন ভন্তের নিদের্শ হল- তোমার লেখাপড়া যা আছে তা নিয়ে
উদ্যম সহকারে নির্বাণ সাক্ষাৎ কর।
৩। বদ্ধজীবন সহ্য
হয় না। অন্যান্য ভিক্ষু শ্রমণদের মত ঘুরাফেরা করতে পারেনা বলে চলে যায়।এদিকে বন ভন্তের
নিদের্শ হল- ভিক্ষু- শ্রমণদের শমথ-বিদর্শন ভাবনায় রত থাকতে হবে।
৪। পর্যাপ্ত পরিমাণ
ঘুমের অভাবে চলে যায়। এ বিষয়ে ভন্তের নিদের্শ হল-তিন চার ঘন্টার অধিক ঘুমাতে পারবেনা।
৫। গৃহীজীবনের মোহে
চলে যায়। এ ব্যাপারে বন ভন্তের নিদের্শ হল-গৃহীজীবন দুঃথজনক। মুক্তির পথ সহজে পায় না।
৬। সদ্ধর্মের আস্বাদ
না পেয়ে চলে যায়। ধর্মের আস্বাদ সম্বন্ধে বন ভন্তের নিদের্শ হল-তুমি চেষ্টা কর।যদি
তোমার পূর্বজন্মের পারমী থাকে, বুদ্ধের নিদের্শ ও ইহজন্মের প্রচেষ্টার দ্বারা একদিন
না একদিন আস্বাদ পাবেই।
৭। অন্যান্য ভিক্ষু
শ্রমণ অথবা অভিভাবকের প্ররোচনায় চলে যায়।এ সম্বন্ধে বন ভন্তের নিদের্শ হল-এক পথ, এক
মত। এক পথ হল আর্য্ অষ্টাঙ্গিক পথ ও একমত হল নির্বাণই গন্তব্য স্থল।
৮। হুজুকে এসে হুজুকে
চলে যায়। এ বিষয়টির উপর বন ভন্তের নিদের্শ হল-মন চঞ্চল করবেনা।
৯। নিরাপত্তার জন্য
কিছুদিন থেকে যায়। এ বিষয়ে বন ভন্তের নিদের্শ হল-নির্বাণই তোমার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা।
১০। ভিক্ষু-শ্রমণদের
মধ্যে কোন্দল হলে চলে যায়। এব্যাপারে বন ভন্তের নিদের্শ হল-মৈত্রী পরায়ণ হও।
আপাততঃ দৃষ্টিতে
দেখা যায় উপরোল্লিখিত দশটি কারণে রাজ বন বিহার হতে ভিক্ষু শ্রমণেরা রংবস্ত্র ছেড়ে চলে
যায়।
একবার জনৈক বড়ুয়া
শ্রমণকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম-আপনি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন, চলে যাচ্ছেন কেন? তিনি
বললেন-ভিক্ষু শ্রমণদের মধ্যে কেহ কেহ আমাকে বড়ুয়া বলে হিংসা করে আবার অন্যদিকে শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তে আমাকে প্রশংসা করলে তারা হিংসায় জ্বলে যায়। আমি তাঁকে উপদেশ দিয়ে বললাম-যে
যা বলুক, যে যা’ মনে করুক, আপনি ঠিক থাকুন, বন ভন্তের দিকে চেয়ে থাকুন।
বন ভন্তে সব সময় জাতীবাদ উচ্ছেদ করার জন্য বারবার জোর দিয়ে থাকেন। ভাবনাকারীদের মধ্যে
প্রথমে মৈত্রী ভাবনা নিতান্তই দরকার। আপনি ব্ন ভন্তের নির্দেশেই চলুন। শেষ পর্য্ন্ত
দেখা গেল তাঁর পারমী না থাকাতে চলে যেতে বাধ্য হন।
শ্রমণকে উপমা
দিয়ে বললাম- একবার শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলেন- আপনি কি চাকমা?
উত্তরে বললেন-না, আবার বললেন- তবে কি? বন ভন্তে বললেন- আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু। আমি চাকমা
হলে চাকমার আচরণ থাকতো, বড়ুয়া হলে বড়ুয়ার আচরণ থাকতো। আমি ভগবান বুদ্ধের শিষ্য। বুদ্ধের
শিষ্যের আচরণ করি সুতরাং আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু।
আর একবার জনৈক
চাকমা শ্রমণ চলে যাওয়ার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। যাওয়ার সময় বলল অত গরম জলে মাছ থাকতে
পারে না।বন ভন্তে খুব গরম এবং বন ভন্তের শিষ্যরাও গরম। তা শুনে বন ভন্তের প্রধান শিষ্য শ্রীমৎ নন্দপাল ভন্তে
বললেন- তুমি যা বল তা অতিশয় সত্য। গরম জলে মাছ থাকতে পারে না। ঠান্ডা জলে থাকতে পারে।
তুমি ঠান্ডায়চলে যাও।এই সংলাপগুলি শুনে আমি খুব হাসাহাসি করলাম।
আরো কয়েকজন ভিক্ষু
শ্রমণ বন বিহার ত্যাগ করার কারণ আমার ষ্মৃতিপটে আঁকা আছে।কিন্তু লেখনির কলেবর বৃদ্ধির
ভয়ে আপাততঃ স্থগিত রাখলাম। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে তাঁর শিষ্যদেরকে উপমায় উপদেশ দিয়ে বললেন-
আমার উপদেশ হল একটা বড় কোচ গাড়ী সদৃশ। আমি হলাম সুদক্ষ চালক, তোমরা আমার গাড়ীতে বস।
আমি তোমাদেরকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাব, কিন্তু উপযুক্ত ভাড়া দিতে হবে। ভাড়া হল শ্রদ্ধা,
ষ্মৃতি, একাগ্রতা ও প্রজ্ঞা। যখন আমি আমার গাড়ী নিয়ে চট্টগ্রাম রওনা হই, তখন দেখা যায়
গাড়ীতে তিলধারণ করার স্থান থাকে না তার অর্থ হল,যাত্রীর আধিক্য। কালক্রমে দেখা যায়
ভেদভেদী পৌছলে অর্ধেক নেমে যায়, মানিকছড়ি গেলে কিছু সংখ্যক নেমে যায়,ঘাগড়া গেলে আরও
কিছু নেমে পড়ে, রাণীর হাট গেলে আরও যাত্রী
নেমে প্রায় খালি অবস্থায় থাকে। গুটি কয়েকজন যাত্রী নিয়ে আমার পরিশ্রম সার্থক হয় না
এবং উদ্যমও থাকেনা। সত্যের পথ আঁকড়ে থাকার জন্য শিষ্যদেরকে লক্ষ্য করে বন ভন্তে নিজেই
গান রচনা করেছেন। এ গান সুর দিয়েছেন বাবু রনজিত দেওয়ান।
ছি! ছি! ছি!
করিস কি তুই
পাগলা ছেলে, পাগলা ছেলে।
সাত রাজার ধন হাতে পেয়ে
অতল জলে দিসনে ফেলে।
এই ভূলে তোর দুকুল যাবে
আপন বুঝে চল।।
কেঁদে কেঁদে তুই কুল পাবিনে
বইবে চোখের জল।
দুখের বোঝা মাথায় নিয়ে
সুখের বোঝা দিসনে পায়ে ঠেলে।

খোড়ার গিরি
লংঘন
“খোড়ার গিরি লংঘন” কথাটি প্রবাদ বাক্য বলা হয়। কেননা যে খোঁড়া বা আতুর
সে কোনদিন পাহাড় পর্বত অতিক্রম করতে পারেনা। এমন কি শক্ত-সমর্থ লোকও গিরি বা
পাহাড় পর্বত অতিক্রম করতে সাহস পায়না।
এ উক্তিটি শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে জনৈকা উপাসিকার উদ্দেশ্যেই করেছিলেন।
উক্ত উপাসিকা বলেছিলেন-আমার যদি লক্ষ লক্ষ টাকা থাকতো আমি বন বিহারের উন্নতি কল্পে
ব্যয় করতাম। বন ভন্তে বললেন-ঠিক কথা,তোমার মত খোঁড়ারাও বলেআমার যদি পা স্বাভাবিক
থাকতো, আমি পর্বত বা গিরি লংঘন করতাম।
ইহার অর্থ হল, যে ইহ জন্মে খোঁড়া সে পূর্ব জন্মে অকুশল কর্ম বা
পাপ কর্মের ফলে খোঁড়া হয়েছে, আর যে, ভাল, ধরতে হবে সে পূর্ব জন্মে পূণ্যকর্ম করে
স্বাভাবিক হয়েছে।
অন্যদিকে দেখা যায় কেহ কেহ ধনাঢ্য বা সম্পদশালী। তারা পূর্ব জন্মে
দান, শীলাদি পালন করে সম্পদশালী হয়েছে। ইহাও সুকর্মের ফল। অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির
মধ্যে দেখা যায় কেহ কেহ পুণ্য কর্ম করে, আর কেহ পূণ্য কর্ম করেনা। যারা পূণ্য
কর্ম করে তারা ভবিষ্যত জন্মের জন্য সম্পদ গচ্ছিত রাখে, আর যারা পূণ্য কর্ম করেনা
তারা পূর্বজন্মের ফল ভােগ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ গচ্ছিত রাখেনা।
মহৎ পূণ্যকর্ম করতে হলে দুটি জিনিষের দরকার। তা হল, পূর্বজন্মের জমাকৃত
সম্পদ ও ইহ জন্মের সদিচ্ছা। এখন কথা হচ্ছে যে, কারো সদিচ্ছা আছে, কিন্তু সম্পদ
নেই। এখানেই সে ব্যক্তি এক প্রকার খোঁড়া বিশেষ। যদি কারো পূণ্যকর্ম করতে ইচ্ছা
থাকে তবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী পূণ্যকর্ম করে যাওয়া উচিৎ। পরবর্তীতে ঐ ব্যক্তি
অফুরন্ত পূণ্যের ফল ভোগ করতে পারবে। দান করাও একপ্রকার বাঁধা। কেননা দান করলে
দানের ফল ভোগ করতে হবে। ভোগ করাও দুঃখজনক। ত্যাগই পরম সুখ। ত্যাগ করা মহাকঠিন।
ত্যাগ বলতে লোভ, হিংসা অজ্ঞানতা, মিথ্যাদৃষ্টি, মান, সন্দেহ, শীলব্রত পরামাশ
প্রভৃতিকে বুঝায়। যতদিন পর্যন্ত অবিধ্যা-তৃষ্ণা বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত আসল
সুখ কি তা বুঝা কঠিন।
আর একদিন শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে আর একজন উপাসিকার উদ্দেশ্যেই একই
উক্তি করেছিলেন। উপাসিকা বলেছিলেন-ভিক্ষু-শ্ৰমণ বন বিহার থেকে রংবস্ত্র ছেড়ে চলে
গেলে আমার বড়ই দুঃখ লাগে। আমি যদি পুরুষ হতাম সারাজীবন বন ভন্তের নির্দেশ
অনুযায়ী চলতাম।
বন ভন্তে উদাহরণ স্বরূপ বললেন-কোন লোক ব্যবসা করতে হলে প্রথমে তার
সঞ্চিত টাকার প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ তার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। তৃতীয়তঃ তার কঠোর
কর্ম প্রচেষ্টার দরকার। এ
তিনটার সমন্বয়ে সে তার ব্যবসায় উন্নতি করতে পারবে। ঠিক তেমনি ভিক্ষু-শ্রমণের
বেলায়ও তাই। যেমন পূর্বজন্মের অফুরন্ত পূণ্য পারমী, ইহ জন্মের অক্লান্ত অধ্যবসায়
বা প্রচেষ্টা এবং ভগবান বুদ্ধের আবিস্কৃত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা পথে চললে
ভিক্ষু-শ্রমণ সফলকাম হতে পারে। উক্ত উপাসিকা বন ভন্তের ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে, বন
বিহার থেকে ভিক্ষু-শ্রমণ রং রস্ত্র ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ অনুধাবন করে দ্বিধা
মুক্ত হন।
ভূতের কাণ্ড
রাজ
বন বিহারের বিভিন্ন মালামাল সংরক্ষণের স্বার্থে নব দীক্ষিত শ্রমণদের পালাক্রমে
বিহার পাহাড়া দিতে হয়। কারণ মধ্যে মধ্যে চোরের উপদ্রব দেখা দেয়।
রাত একটায় তিনজন শ্রমণ হাটতে হাটতে গেইটের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন
সময় সামনের দিক থেকে দুইজন লোক আসতে দেখে তাঁরা উল্টা দিকে প্রস্থান শুরু করেন। লোকদ্বয়
হঠাৎ দৌড়ে এসে একজন শ্রমণকে হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। অন্য দুইজন শ্রমণ তাঁকে
রক্ষা করতে পারলেন না। প্রায় ত্রিশ হাত টেনে নেয়ার পর হঠাৎ অপহৃত শ্রমণ সহ লোকদ্বয়
অদৃশ্য হয়ে যায়। তাঁরা অত্যন্ত ভীত হয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে ঘটনার কথা
জানালেন-বন ভন্তে বললেন- যাও তোমরা গিয়ে বিশ্রাম কর। সারারাত তাদের ঘুম হয়নি।
প্রতিদিনের নিয়ম অনুসারে ভোর চারটায় মাইকে সূত্রপাঠ করার পর ভূতে নেওয়া শ্ৰমণ
এসে বন ভন্তেকে বন্দনা করতে দেখা গেল।
এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বন বিহারের সাবেক সহ-সভাপতি পরলোক গত
বাবু জ্যোর্তিময় চাকমা মহোদয় শ্রমণকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। শ্রমণ বিবরণ দিয়ে
বলেন-যখন আমাকে ধরে ফেলে তখন আমরা তিনজনে তাদের সঙ্গে শক্তি প্রয়োগ করেও হেরে যাই।
তারপর আমি বেহুস অবস্থায় কোথায় ছিলাম তা জানিনা। হঠাৎ যখন আমার হুস আসে তখন
বুঝতে পারলাম আমি একটা ঘরে বসে আছি। সামনে একজন বৃদ্ধলোক দা হাতে নিয়ে বসে আছে।
বৃদ্ধ আমাকে অভয় দিয়ে বল্ল-শ্রমণ, তুমি ভয় করো না। ভোর হলে তোমাকে বন বিহারে
দিয়ে আসবো। বৃদ্ধের দুই যুবতী মেয়েকে ক্রুদ্ধস্বরে বলল-তোরা আর জায়গা পাসনি বন
ভন্তের শ্রমণ নিয়ে এসেছিস। তাদেরকে দা দেখিয়ে আমার পাশে বসে রইল। তাদের ভাষাও
কথাগুলি অন্য ধরণের কিন্তু আমি বুঝতে পারি। মেয়েরা দূর থেকে তাদের বাবাকে বলল-আমরা
শ্রমণকে বিয়ে করবো। বৃদ্ধ রাগ করে দা-খানা তাদের প্রতি ছুঁড়ে মারল কিন্তু অল্পের
জন্যে পড়েনি। কিছুক্ষণ পর সূত্র পাঠের শব্দ শুনে বৃদ্ধ আমাকে বল্ল সূত্র পাঠ শেষ
হওয়ার পর তোমাকে নিয়ে যাব। বৃদ্ধ আমার হাত ধরে কোথায় নিয়ে গেল আর জানি না, শেষেবুঝতে
পারলাম আমি বন বিহারের উত্তর দিকে হেঁটে বন ভন্তের দিকে আসতেছি। তারপর বন ভন্তেকে
বন্দনা করে শ্রমণ শালায় চলে গেলাম।
বাবু জ্যোতির্ময় চাকমা মহোদয় ঘটনার বিবরণ দেওয়ার পর আমি বললাম-দাদা,
এটাত একটি উপন্যাস। তিনি বললেন-ছোট খাট উপন্যাসও বলা যায়।
ভুতের দুষ্টামি
একদিন
তবলছড়ি এলাকার বাবু সাধন চন্দ্র বড়ুয়া সহ আমি রাজ বন বিহারে দেশনালয়ে বসে আছি।
সেখানে আরো দশ পনের জন লোক বসে আছেন। সে সময় শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে ভোজন করছিলেন। বন
বিহারের সাবেক সহ-সম্পাদক বাবু বঙ্কিম দেওয়ানকে দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-আপনি শ্রমণ
হয়েছিলেন, কবে রং বস্ত্র ছাড়লেন? তিনি বললেন পনের দিন প্রব্রজ্যা জীবন যাপন করে
গত পরশু রংবস্ত্র ছাড়লাম। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করার পর কথা প্রসঙ্গে
ভূতের কথা উথাপন হল। বিবরণে তিনি বলেন-একবার রাতে পায়খানায় যেতে ছিলাম হঠাৎ
পশ্চিম দিকের অশ্বথ গাছটি (পাউজ্যা) আমার পথরোধ করে পড়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে
দেখলাম কোন বাতাস নেই। অমনি গাছটি থর থর করে কেঁপে উঠল। তাতে আমার সর্বশরীর শিহরে
উঠে পায়খানার ঘটিটি হাত থেকে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি আমি বন ভন্তের নিকট
চলে যাই। তখন বন ভন্তে দেশনালয়ে ধ্যানস্থ অবস্থায় আছেন। হাপিয়ে হাপিয়ে বন
ভন্তেকে ভয়ের কথা জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে বন ভন্তে বলেন-দেখত গাছটি দাঁড়ান আছে।
আমি সত্যিই দেখলাম গাছটি দাঁড়ান আছে। ভন্তেকে আবার আমি বললাম-তবে আমি কি দেখলাম?
বন ভন্তে বললেন-সে তোমাকে রহস্য করেছে। তোমার সাহস আছে কি নেই পরীক্ষা করছে। সে
পূর্বে দুষ্ট ছিল। প্রতিদিন সূত্র শুনতে শুনতে সে এখন শিষ্ট হয়েছে। অনিষ্ট
করবেনা। আমরা কথা বলতে বলতে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে দেশনালয়ে চলে আসলেন।

স্বপ্নে কুকুরে
কামড়ায়
সময়
বিকাল প্রায় পাঁচটা শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে দেশনালয়ে লেখাপড়ায় রত আছেন। আমরা
(উপসাক-উপাসিকা) তাঁর সামনে নীরবে বসে আছি। আমার চোখে পড়ল। বিহারের দক্ষিণ পাশে
কয়েক জন লোক জড়ো হয়ে কি যেন বলাবলি করছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা দেশনালয়ের দিকে
চলে আসল। দেবাশীষ নগরের জনৈক লোক কতকগুলি থালা ও বাটি বন ভন্তের সামনে রেখে বলল
ভন্তে, এগুলি আমি চুরি করিনি আমাদের পাড়ার লোক থেকে অল্পদামে কিনে নিয়েছি। সে
প্রত্যহ বন বিহারের এসে কাজ করে।
বন বিহারের কুকুরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল-ভন্তে, এ
কুকুরগুলি স্বপ্নে আমাকে কামড়াতে চায়। দুই তিন রাত স্বপ্ন দেখে অনন্যোপায় হয়ে
আপানার নিকট চলে এসেছি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন। আমরা (স্বামী-স্ত্রী) যেন
শান্তিতে ঘুমাতে পারিমত আশীর্বাদ করুন।
বন ভন্তে তাকে অভয় দিয়ে বললেন-যাও, যাও, আর কামড়াবে না। এ ঘটনা
দেখে আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, এ রকম চুরি অনেক বিহারে হয়ে থাকে কিন্তু এ রকম
অলৌকিক প্রমাণ কোনদিন আর দেখিনি। তাহলে তাদের পরকালে কি অবস্থা হবে?
লোকে
যাহা বিষ বলে বিষ তাহা নয়।
সংঘের
সম্পত্তি বিষ সম উক্ত হয়।
বারেক
পানেতে বিষ বারেক মরণ।
সদা
মৃত্যু সংঘদ্রব্য করিলে হরণ ।।
দেবতা—যক্ষ-প্রেত
শ্রদ্ধেয়
বন ভন্তের প্রধান শিষ্য শ্রীমৎ নন্দপাল স্থবির মহোদয়কে
আমি একদিন কৌতুহল বশতঃ প্রশ্ন করলাম-ভন্তে, আপনি কোনদিন দেবতা-যক্ষ-প্রেত দেখেছেন?
তিনি একটু হেসেই বললেন-এইতো কিছুদিন আগেই দেখলাম। প্রতিদিন ভোর চারটায়। বুদ্ধ
বন্দনা করে আমার আসনে ধ্যানস্থ হই। তখন দেখা যায় একজন শ্রমণ এসে ঘর পরিস্কার করে
চলে যায়। কিছুদিন পর আমার মনে উদয় হল অন্ধকারে ভাল ভাবে ঘর পরিস্কার হচ্ছেনা।
তাই বলে বাতি জ্বালানোর জন্য সুইচ টিপার সাথে সাথেই অন্ধকারে দেখা শ্রমণ অদৃশ্য
হয়ে যায়। হাত থেকে ঝাড়ুখানা পড়ার দৃশ্যটিই শুধু দেখলাম। তাতেবুঝলাম দেবতারাই
মনুষ্যবেশে পুণ্য করতে আসে।
আর একদিন রাত্রে চংক্রমণ করার সময় আমার সামনেই কি যেন একটা প্রাণী
চলে যায়। দেখতে যেন মহিষ বা শুকর মনে হল। মনে মনে যক্ষ বলার সাথেই অদৃশ্য হয়ে
গেল। প্রেত সম্বন্ধে তিনি বলেন-প্রেত
দেখেছি আমি যখন শ্রমণ অবস্থায় তখন বার্মার এক বিহারে ছিলাম। সেই বিহারে ভাবনাকারীদের
জন্য কতকগুলি নর কংকাল সংরক্ষিত ছিল। প্রায় রাত্রেই কংকাল নাড়াচাড়ার শব্দ শুনা
যেত। এমন কি অনেকেই প্রেত দেখতে পেয়েছে। একরাত্রে আমি শব্দ শুনে দেখলাম-একজন
বৃদ্ধা কংকালগুলি নাড়াচাড়া করতে করতে পায়চারী করতেছে। আমি পিছন দিকে দেখতে
দেখতে তার মুখ দেখার কৌতহল হলে হঠাৎ বৃদ্ধা অদৃশ্য হয়ে যায়।
অজ্ঞানতার কারণে
সময়
তখন প্রায় দশটা। দেশনালয়ে অনেক উপাসক-উপাসিকা মনোযোগের সাথে বন ভন্তের দেশনা
শ্রবণ অবস্থায় বসে আছেন। এমন সময় ভন্তের জনৈক শিষ্য একটা বড় এলুমিনিয়ামের
গামলা চৌকির উপর রেখে বন ভন্তের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন-দেখুন ভন্তে ! বাচ্চুরি
(বাঁশের কচি চারা) নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে দেখে গামলাসহ ফেলে পালিয়ে যায়। বন ভন্তে
দেখেও না দেখার মত, শুনেও না শুনার মত হয়ে আমাদেরকে ধর্ম দেশনা প্রদানে রত ছিলেন।
উক্ত শিষ্য চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মধ্যবয়সী এক মহিলা এসে বন ভন্তেকে বন্দনা করে
বল্ল-এ গামলাটি আমার। আমরা সবাই সমস্বরে হেঁসে উঠি এবং সে ঐটি ফেরৎ চাওয়ার অবকাশ
আর পেল না। বন ভন্তে আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন-অজ্ঞানতার কারণে এগুলি হয়ে থাকে।
তার যদি জ্ঞান থাকতো বন বিহার এলাকায় বাচ্ছুরি চুরি করতো না দ্বিতীয়তঃ সে যদি এম,
এ পাশ হতো এসব লজ্জাঙ্কর কাজ হতে বিরত থাকতো। তৃতীয়তঃ সে যদি বড় লোকের মেয়ে হতো
বাজার থেকে চাকরদ্বারা বাচ্ছুরি এনে খেতো।
তিনি বিভিন্ন উপমা দিয়ে লোকত্তর দেশনায় বলেন-মার্গফল না হওয়া
পর্যন্ত শিক্ষিত এবং বড় লোকেরাও অনার্য কাজে (অন্যায় কর্মে) লিপ্ত থাকে। সাড়ে
দশটায় বন ভন্তের স্নানের সময় হওয়ায় দাঁড়িয়ে তিনি মহিলাটিকে বললেন নিয়ে যাও।
তা শুনে আমরা আবারো হেসে উঠে বন ভন্তকে বন্দনা করে দেশনালয় থেকে তাকে বিদায়
দিলাম।
যক্ষের ভয়
একদিন
বন বিহার দেশনালয়ে অনেক উপাসিকার ভীড়। আমি বুদ্ধ বন্দনা করার পর উপাসিকাদের মুখে
শুনতে পেলাম-ভন্তে, অনুগ্রহপূর্বক যক্ষাটিকে তাড়িয়ে দিন। বন ভন্তে বলেন তাড়িয়ে
দিলে যেখানে যাবে সেখানে ক্ষতি করবে। আবার তারা বলল-ভন্তে, আমাদের সাংঘাতিক ভয়
লাগছে। তাড়িয়ে দিলে ভাল হয়। ভন্তে বললেন-অরবিন্দকে তাড়িয়ে দিলে ভাল হয়। তারা
আবার বলল-অরবিন্দ বাবুকে না, যক্ষটিকে তাড়িয়ে দিন। তাপর বন ভন্তে বিশদভাবে বললেন
যে ভাল সে সব জায়গায় ভাল। যে খারাপ সে সব জায়গায় খারাপ। অরবিন্দ যদি খারাপ কাজ
করে আজ আমি যদি তাকে বুঝিয়ে খারাপ কাজ থেকে বিরত করি তা হবে উত্তম কাজ। সে রকম
যক্ষটিকে তাড়িয়ে না দিয়ে কারো অনিষ্ট করতে না পারে মত ব্যবস্থা করলে ভাল হয়।
তারপর বন ভন্তে অভয় দিয়ে বললেন-এখন থেকে ভিক্ষু দিয়ে পরিত্রাণ সূত্র শ্রবণ কর
সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি উৎকন্টিতে হয়ে উপাসিকা ধনার মাকে জিজ্ঞাসা করলাম-দিদি, কি
ব্যাপারে। তিনি প্রকাশ করলেন কালিন্দিপুরের এক নির্জন বাড়ীতে যক্ষের উপদ্রব
হয়েছে। ঐ বাড়ীতে মধ্যে মধ্যে লোক থাকে না, মধ্যে মধ্যে একজন লোক থাকে। রাত্রে
ঘরের বাইরে যায় না। গতকাল রাত্রে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায়। সে লোক ঘুমানোর সময়
বিকট শব্দ শুনে তার গুম ভেঙ্গে যায় দ্বিতীয়বার অন্য ধরণের শব্দ করে ঘরের বেড়া
ঘেসে কি যেন চলে যায়। মনে হল একটা গরু চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে ভিটার অপর প্রান্তে
আর একটি শব্দ শুনতে পায়। সকাল বেলায় দেখা গেল উঠনের মধ্যে এক হাত গোলাকার গর্তের
মধ্যে কতগুলি জমাট রক্ত পড়ে আছে। আবার সে গর্ত হতে বেড়া ঘেসে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত
বড় বড় ফোটা ফোটা রক্তের দাগ দেখা যায়। জানাজানিতে এলাকাবাসী আতংকিত হয়ে
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের নিকট অভয় প্রার্থনা করল। ধনার মার মুখে বিবরণ শুনে পরে খোঁজ
নিয়ে জানতে পারলাম আর কোন সময় ঐ এলাকায় যক্ষের উপদ্রব হয়নি।
দিব্য চোখে
দেখে!
প্রায়
সময় লক্ষ্য করা যায় রাজ বন বিহারে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের উদ্দেশ্যে উপাসক-উপাসিকারা
বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী নিয়ে আসেন। কারো দানীয় সামগ্রী তিনি সাদরে গ্রহণ করেন,
কারো দানীয় সামগ্রী স্পর্শ করেন আবার কারো দানীয় সামগ্রী চৌকির উপর রেখে দেয়ার
নির্দেশ দেন। আমার ধারণা দানীয় সামগ্রী সাদরে গ্রহণ করা, স্পর্শ করা এবং চৌকির
উপর রেখে দেয়ার নির্দেশে বেশ পার্থক্য আছে। গভীর শ্রদ্ধা, মধ্যম শ্রদ্ধা এবং মৃদু
শ্রদ্ধার কারণে ত্রিবিধ অবস্থায় পরিণত হয় কিন্তু এক ব্যতিক্রমধর্মী দানীয়
বস্তুর ব্যাপার সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকাদেরকে জ্ঞাত করছি। সেদিন ছিল উপপাসথের তারিখ ।
অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন উপাসক উপাসিকারা সংখ্যায় বেশী ছিল। শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তে আমাদেরকে ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন, এমন সময় জনৈক আমার অপরিচিত উপাসক কতকগুলি
দানীয় সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন। প্রত্যেক দানীয় সামগ্রী তিনি সাদরে গ্রহণ করেন,
কিন্তু তিনি বললেন-ওটা থাক। দ্বিতীয়বার দেয়ার জন্য উদ্যত হলে তিনি বলেন- (চৌকি
দেখায়ে) ওখানে রাখ। তৃতীয়বার উপাসক বললেন-ভন্তে, এটা আমার নূতন গাছের প্রথম ফল,
আপনার উদ্দেশ্যেই এনেছি। তৎপর বন ভন্তে আমাকে দেখায়ে বললেন-তাকে দাও। বন ভন্তের
আদেশ পেয়ে আমি নারিকেলটি গ্রহণ করে আমার কাছেই রেখে দিলাম। রাত্রীতে যখন ভিক্ষু
সংঘের ভোর বেলার পায়স অন্নের আয়োজন হচ্ছিল তখন আমি সে নারিকেলটি ভেঙ্গে দেখলাম
ওটাতে পানি ও নারিকেল নেই। অতঃপর উক্ত বড় আকৃতির নারিকেলটি উপাসিকা ধনার মাসহ
উপাসক-উপাসিকারা দেখে অবাক হলেন। আমাদের ধারণা শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে “দিব্য চোখে দেখে” শূণ্য নারিকেলটি গ্রহণ
করেননি।
শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তে কতটুকু লেখাপড়া করেছেন?
একদিন
সকাল ১০টায় বন ভন্তে বন বিহার দেশনালয়ে উপাসক-উপাসিকাদেরকে দেশনা করচ্ছিলেন তখন
১০/১২ জন ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলা সেখানে উপস্থিত হন। তাঁদের মধ্যে জনৈক ভদ্রলোক বললেন-আমরা
একটু বন বিহার দেখতে এসেছি। বন ভন্তে বললেন-দেখতে পারেন। কিছুক্ষণ পর তাঁরা বন
ভন্তের সঙ্গে সামান্য আলাপ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন।
জনৈক
ভদ্রলোকঃ আপনি কি চাকমা?
বন
ভন্তেঃ না।
জনৈক
ভদ্রলোকঃ তবে কি?
বন
ভন্তেঃ আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু। আমি চাকমা হলেই চাকমার স্বভাব থাকত, আর যদি বড়ুয়া
হতাম, বড়ুয়াদের স্বভাব হত। বৌদ্ধ ভিক্ষুর যা প্রয়োজন তা আমি.......।
জনৈক ভদ্রলোকঃ এ বিহার আপনি পরিচালনা করেন?
বন
ভন্তে ? না।
জনৈক
উপাসকঃ বিহার পরিচালনা কমিটি আছে।
বন
ভন্তেঃ আপনারা কোথা হতে এসেছেন।
জনৈক
ভদ্রলোকঃ যশোহর হতে।
বন
ভন্তেঃ আপনারা কি কাজ করেন?
জনৈক
ভদ্রলোকঃ আমরা সবাই ওকালতি করি।
বন
ভন্তেঃ কেউ ব্যারিষ্টারী পাশ করেছেন?
জনৈক
ভদ্রলোকঃ না।
বন
ভন্তেঃ উকিল, ব্যারিষ্টার অজ্ঞানী ও মিথুক। শুধু ভাত খাওয়ার জন্য লেখাপড়া। ওকালতি,
পিএইচ, ডি, ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত ভাত খাওয়ার জন্য লেখাপড়া করেন। বন ভন্তে এ উক্তি
করার সাথে সাথেই তাঁদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাঁদের মধ্যে অপর ব্যক্তি
বললেন—আপনি
কতটুকু লেখাপড়া করেছেন?
বন
ভন্তেঃ আপনাদের লেখাপড়ায় যা বলবেন তা আমি বুঝতে পারব, কিন্তু আমি যা লেখাপড়া
করেছি তা যদি বলি আপনারা বুঝতে পারবেন না।
জনৈক
ভদ্রলোকঃ বুঝতে পারি কিনা দয়া করে একটু বলুন।
বন
ভন্তেঃ দেশে যত সব মারামারি, কাটাকাটি, রাহাজানি এবং নানা অশান্তির সৃষ্টি হয়
একমাত্র অজ্ঞানতা ও মিথ্যার কারণে। একজন অপর জনকে ক্ষমা করতে পারেনা। মৈত্রী ভাব পোষণ
করতে জানেনা, অপরের সুখ সমৃদ্ধি দেখতে পারেনা, মানুষের মধ্যে দয়াভাব একেবারে নেই
বললেই চলে। হীনত্বে মহত্ব অর্জন হয়না বরঞ্চ নানা দুঃখের সৃষ্টি হয়। দুঃখে থাকলে
মানুষ মুক্তি পায়না সুখ ভোগেও মানুষ মুক্তির পথ পায়না সুতরাং যারা পরম সুখ বা
মুক্তির পথ অন্বেষণ করবে তাঁরা প্রথমেই জ্ঞান ও সত্যের গবেষণায় নিজকে নিয়োজিত
রাখতে হবে।
ত্যাগেই
সুখ বয়ে আনে। লোভ হিংসা, অজ্ঞানতা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাদৃষ্টি ও অহংকার ত্যাগ
করতে পারলে সর্ববিধ দুঃখ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের সংক্ষিপ্ত উপদেশাবলী শুনে
তাঁরা কিছুটা সন্তুষ্ট হয়ে চলে যান।
ভাল না মন্দ?
কোন এক ছোট খাট ধর্মীয়
অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে রাজ বন বিহারের দেশনালয়ে উপাসক-উপাসিকাদের ভীড়ে কোথাও ঠাঁই
নেই। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে ধর্মার্থীদেরকে লক্ষ্য করে বলেন-আজ যারা এখানে সমেবত
হয়েছ, তারা সবাই ভাল না মন্দ (গম না বজং)? উপাসকদের মধ্যে কেহ কেহ ভাল উত্তর দিল।
উপাসিকাদেরকে বন ভন্তে বললেন-তোমরা কি বল? তাদের মধ্যে প্রায় সকলে বলে উঠল-ভাল
ভন্তে। তারপর বন ভন্তে বললেন- তা হলে সবাই ভাল। কেহ কেহ বল-খারাপ হলে আমরা
এখানেআসতামনা। বন ভন্তে আবার বললেন-তা’ হলে বুঝা যায় এখানে যারা আসেনি তারা খারাপ? কেহ কেহ
উত্তর দিল—সবাই
ভাল, আর সবাই খারাপ ও নয়। বন ভন্তে ভাল মন্দ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে বলেন-এ সংসারে
ভাল কে? আর মন্দ কে? যাঁরা শীল সমাধি ও প্রজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্রোতাপত্তি
মার্গ, স্রোতাপত্তি ফল, সকৃদাগামী মার্গ, সকৃদাগামী ফল, অনাগামী মার্গ, অনাগামী
ফল, অর্হত মার্গ ও অর্হত ফল লাভী তাঁরাই প্রকৃত রূপে ভাল বলে অভিহিত। বন ভন্তে এ
ধর্মদেশনা দেয়ার সাথে সাথেই যারা ভাল বলেছিল তাদের প্রায়জনের মুখ মণ্ডলে অন্ধকার
নেমে আসে। কারণ ভাল বলে দাবী করে ফলবতী হয়নি। পরিশেষে বন ভন্তে বললেন-খারাপ কে?
যে, সব সময় খারাপ কাজে লিপ্ত থাকে, ভাল কাজ করতে জানেনা তাকে খারাপ বলা যায়।
আবার যারা আজকে শীল পালন ও বিভিন্ন পূণ্যানুষ্ঠান করে পরবর্তীতে খারাপ কাজে লিপ্ত
থাকবে তাদেরকে মিশ্র কর্মী বলা হয়। তারা পরকালে সুগতিগমন অনিশ্চিয়তায় কালযাপন করবে
সুতরাং তোমরা আপাততঃ ভালও নয় মন্দও নয়। পরিশেষে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে লোকোত্তর
ধর্ম দেশনা করে তাঁর বক্তব্যের ইতি টানেন।
ইহকাল-পরকাল
১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ ইংরেজী
সোমবার রাজ বন বিহারের দেশনালয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে আমাদেরকে নিম্নেক্ত দেশনাগুলি
প্রদান করেন।
ইহকাল যেমন আছে পরকালও তেমন
আছে তা বিশ্বাস করতে হবে। অনেকে মনে করে যাবতীয় ধর্মকর্ম পাপ পূণ্য ও সকল কিছু
ইহকালে সংঘটিত হয়। মরণের পর আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এ ধরণের বিশ্বাসকে মিথ্যা
দৃষ্টি বলা হয়। মিথ্যাদৃষ্টি মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। অন্ধ লোক যেমন কোন কিছু
দেখতে পায় না, তেমন মিথ্য।দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিও মুক্তির পথ পায়না।
দেশনায় বন ভন্তে বলেন- ঢাকা
হতে আগত জনৈক ভদ্রলোক শ্রদ্ধেয় বন ভন্তেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-আপনি যা কিছু বলেন
বা ভাষণ দেন তা’ কি
শাস্ত্র বা বই পুস্তক হতে বলে থাকেন; না কি আপনার অভিজ্ঞতা হতে বলে থাকেন? উত্তরে
বন ভন্তে বলেন-আমি আমার অভিজ্ঞতা হতে বলে থাকি। তারপর বন ভন্তে ইহকাল – পরকাল সম্বন্ধে ব্যাখ্যা
করে বলেন-এ সংসারে অনেকে অতিদুঃখে কাল যাপন করে। এমন কি জ্বরা, ব্যাধি ও সংসারের
নানা দুঃখ কষ্ট সহ্য করে জীবন অতিবাহিত করে। শীল পালন করায় মরণের পর নরক বা
অপায়ে গমন করে। এখানে দেখা যাচ্ছে ইহকালে অতিব দুঃখে কাল যাপন করে পরকালেও অতীদুঃখে
পতিত হয়।
এ সংসারে কিছু কিছু লোক দেখা
যায়, তারা গরীব হোক অথবা সম্পদশালী হোক, শিক্ষিত হোক অথবা অশিক্ষিত হোক তারা অতি
দুঃখে কাল যাপন করে থাকে। শীল পালন হেতু কোন কাজে, কোন কথায় ও কোন জীবিকায় সব
সময় বাঁধার সম্মুখীন হয়ে তারা সারাজীবন দুঃখভোগ করলেও মরণের পর স্বর্গ সুখ ভোগ
করে।
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে প্রায়
সময় বলে থাকেন- “তোমরা
আজ মরে যাও, কাল মরে যাও অথবা যে কোন দিন মরে যাও, তথাপিও শীলচ্যুত হইও না। এমন কি
ইহ জীবনকে তুচ্ছ মনে করে জীবন কাটিয়ে স্বর্গে চলে যাও। তোমাদের উদ্দেশ্য ঠিক
থাকলে পরকালে যে কোন জন্মে নির্বাণ লাভ করতে পারবে।”
এ সংসারে চিৎ দেখা যায়,
কিছু কিছু লোক কঠোর অধ্যবসায় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে মার্গফলের
অধিকারী হন। তাঁরা সংখ্যায় অতি নগন্য। তাঁরা ইহ জীবনে পরম সুখে জীবন যাপন করেন ও
পরকালেও সুখে কাল যাপন করেন। মার্গফল লাভীর ইহ জীবনে যতই বাঁধা বিপত্তি আসুখ না
কেন, তাঁরা সুখে দুঃখে অটল থাকেন। তাঁদের চিত্ত কম্পিত হয়না। তাঁদের চিত্তে কোন
দুঃখ না থাকাতে পরম সুখ শান্তিতে কাল যাপন করেন এবং পরকালেও সুখে শান্তিতে থাকেন
সুতরাং প্রত্যেক মুক্তিকামী উপাসক-উপাসিকাদের মার্গফল লাভ করার জন্য উদ্যোগী হওয়া
একান্ত আবশ্যক। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে প্রায় সময় জোর দিয়ে বলেন- “তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর।
বিশ্বাসই পরম বন্ধু এপার ও ওপারে।” বিশ্বাস হল—ত্রিরত্নের উপর বিশ্বাস, ইহকাল-পরকাল বিশ্বাস, কর্ম ও
কর্মফলের উপর বিশ্বাস, চারি আর্য সত্যের উপর বিশ্বাস, অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপর
বিশ্বাস ও পটিচ্ছ সমুপ্পাদ এর উপর বিশ্বাস। বিশ্বাসেই মানুষের সুখ ও শান্তি নেমে
আসে।
সবাই ভাল চায়
আজ (১৭-২-৯২) রাজ বন বিহার
দেশনালয়ে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনায় বলেন-এ
সংসারে সবাই ভাল চায়। যেমন কোন এক পরিবারে পিতা হল পরিবারের কর্তা। পিতা সব সময়
চায়- আমার ছেলে মেয়েগুলি কাজে কর্মে, কথা-বার্তায় ও আচার-আচরণে খুব ভাল হোক।
খারাপ হওয়া কারো কাম্য নয়। যেমন গ্রামের মধ্যেও মেম্বার, চেয়ারম্যান আবাল বৃদ্ধ
বণিতা সবাই ভাল হোক ভাল ভাবে জীবন যাপন করুক এটি সবারই কাম্য। দেশের মধ্যেও তাই
অমঙ্গল দূরীভূত হয়ে মঙ্গল চিরদিন অটুট থাকুক সবারই কাম্য, কিন্তু প্রায় দেখা
যায় ভাল-এর পরিবর্তে খারাপ, মঙ্গল-এর পরিবর্তে অমঙ্গল পরিলক্ষিত হয়। এর কারণ কি?
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে বলেন- এ সংসারে পঞ্চ কামভোগীদের বহুদোষ সুপ্ত ভাবে থাকে।
ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ পায়, তা অনেক দুঃখ প্রসব করে। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা কখনও
পঞ্চকামে রমিত হন না। তাঁরা অনাসক্ত ভাবে জীবন যাপন করেন। সংসারে নানা দুঃখের কারণ
হল আসক্তি। যেমন দেশের মধ্যে প্রায় দেখা যায় চুরি, ডাকাতি, খুন, লুটতরাজ প্রভৃতি
দুঃখজনক কাজ লেগেই আছে। ক্ষমতার মোহে একজন অপর জনকে খুন করতেকুণ্ঠিত হয়না। হিংসার
বশবর্তী হয়ে একজন অপরজনের অনিষ্ট করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। এগুলির কারণ হল
আসক্তি।
এ সংসারে কেহ হাসে, আবার কেহ
কাঁদে, বিচিত্র ব্যাপার। এসব হাসি- কান্না ও সুখ দুঃখ পর্যবেক্ষণ করে শ্রদ্ধেয় বন
ভন্তে বলেন- তোমরা কি ভাবে আছ জান? গভীর ঘুমে অচেতন ভাবে আছ। মধ্যে মধ্যে ঘুমে
স্বপ্ন দেখে আজেবাজে বকাবকি কর (চাকমা ভাষায় ছন্দবাস মাতা)। যেমন আমার বাড়ী,
আমার স্ত্রী, আমার পুত্র-কন্যা, আমার বিষয়-সম্পত্তি, মেম্বার, চেয়ারম্যান,
মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট প্রভৃতি।
বন ভন্তে আরারো উদাহরণ দিয়ে
বলেন- যদি কোন খারাপ লোক মারা যায় তার জন্যে লোকে দুঃখ করে না। ভাল লোক মারা গেলে
তার জন্য সবাই দুঃখ করে। তিনি আরো বলেন- ধর, তোমার ছেলের জন্য বৌ এনেছ। সে খুব ভাল
দেখতে খুব সুন্দরী, কাজে-কর্মে, কথা-বার্তায় সবার জন্যে খুব ভাল হঠাৎ মারাত্মক রোগ
হয়ে সে মারা গেল, তাতে তোমরা দুঃখ পাবেত? উপাসক-উপাসিকারা বলেন-হ্যা ভন্তে! তারপর
বন ভন্তে বললেন- সংসারে যারা অজ্ঞানী তারা শুধু ভাল চায়। আর যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা
খারাপও চান না, ভালও চান না। ভাল এর মধ্যে খারাপও অর্ন্তনিহিত থাকে। উভয় দিক
বর্জন করতে না পারলে জ্ঞানী হওয়া যায় না। জ্ঞানীরা এমন কি মনুষ্য সুখ, দেব সুখ ও
ব্রহ্ম সুখের জন্য আকাংখিত নন। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য হল পরম সুখ-নির্বাণ।
ট্রেক্টর যোগাড়
কর
শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে আজ
দেশনালয়ে উপাসক-উপাসিকাদের প্রতি লক্ষ্য করে ধর্ম দেশনায় বুলেন- তোমরা ট্রেক্টর যোগাড়
কর। অত বড় বড় গাছের মূল (জারুলের ঘুইট্যা) ভাঙ্গা, অকেজো দা দিয়ে সমূলে উৎপাটন
করতে কোন দিন পারবে না। তোমাদের যেমনি ভাঙ্গা বা অকেজো দা তেমনি তোমাদের উদ্যমও
অতীব ক্ষীণ। এভাবে গাছের মূল। ধ্বংস করা অসম্ভব ব্যাপার।
তিনি বিশ্লেষণ করে বলেন- “প্রকান্ড গাছের মূল হলো-
অবিদ্যা, তৃষ্ণা, মান, মিথ্যাদৃষ্টি, সন্দেহ, শীলব্রত পরামাশ, সৎকায় দৃষ্টি,
তন্দ্রা, আলস্য প্রভৃতি। এগুলিকে সমূলে উৎপাটন করতে হলে ট্রেক্টর রূপ সত্যজ্ঞান বা
প্রজ্ঞার প্রয়োজন। সে ট্রেক্টর তোমার কাছে যদি না থাকে ভাড়া করে নিয়ে এস? ভাড়া
করতে হলেও অনেক টাকার প্রয়োজন। গাছের মূল থাকলে তোমাদের জমিনে ফসল হবে না সুতরাং তোমরা
ট্রেক্টর যোগাড় কর”।
ট্রেক্টরের প্রথম আঘাতে ছোট ছোট
মুলগুলি ধ্বংস হবে। সেগুলি হলো মিথ্যা দৃষ্টি, সন্দেহ, শীলব্রত পরামাশ, সৎকায়
দৃষ্টি, তন্দ্রা-আলস্য প্রভৃতি অবিদ্যা-তৃষ্ণাও মানের চার ভাগের একভাগ মূল ধ্বংস
হবে। সে সময়কে স্রেতাপত্তি বলে।
ট্রেক্টরের দ্বিতীয় আঘাতে
অবিদ্যা-তৃষ্ণা ও মান এর চার ভাগের দুই ভাগ অর্থাৎ মূলের অর্ধেক ধ্বংস হবে। সে
সময়কে সকৃদাগামী বলে।
ট্রেক্টরের তৃতীয় আঘাতে
অবিধ্যা তৃষ্ণা ও মানের চার ভাগের তিন ভাগ অর্থাৎ মূলের মাত্র এক ভাগ বাকী থাকবে।
সে সময়কে অনাগামী বলে ।
টেক্টরের চতুর্থ আঘাতে
অবিদ্যা-তৃষ্ণার বাকী অংশটুকুও ধ্বংস হবে। সে সময়কে অর্হৎ বলে।
স্রোতাপত্তি ফল লাভ করতে
পারলে নরক, তীর্যক, অসুর ও প্রেতদ্বার বন্ধ হয়ে সাত জন্মের মধ্যে নির্বাণ লাভ
হয়। সকৃদাগমী ফল লাভ করতে পারলে দুই জন্মের পর নির্বাণ লাভ করা যায়। অনাগামী ফল
লাভ হলে শুদ্ধাবাস ব্রহ্মলোকে অবস্থানকালীন নির্বাণ লাভ হয় অর্থাৎ এ পৃথিবীতে আর
আগমন হয় না। অর্হৎ ফল লাভ হলে ইহ জন্মে নির্বাণ লাভ করা যায়।
ধর্মজ্ঞান
আজ ৩০-৩-৯২ রাজ বন বিহারের
দেশনালয়ে উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে এক অভূতপূর্ব ধর্মদেশনা
প্রদান করেন। দেশনার বিশেষত্ব হলো যে তিনি ছোট বেলায় যাত্রাগান দেখেছেন ও কবিতা
মুখস্থ করেছেন তা উপদেশ রূপে বিশেষ ভাসমায় আবৃত্তি করেন। জনৈক মহিলার স্বামীর
অকাল মৃত্যুতেও তার শোক প্রশমিত করার জন্য এক নাতি দীর্ঘ কবিতা পাঠ করেন। তাতে
উক্ত মহিলার শোক প্রশমিত হয়। কবিতার বিষয়বস্তু হল-রাতের বেলায় সমস্ত বিশ্ব
অন্ধকারে আবৃত থাকে কিন্তু সে অন্ধকার স্থায়ী নয়। দিনের আলো অবশ্যম্ভাবী। সেরূপ তোমার
দুঃখও চিরদিন থাকবেনা সুখের পরশ নিশ্চয়ই একদিন পাবে। তুমি শোক সংবরণ কর। কবিতা
পাঠান্তে উক্ত মহিলার মুখশ্রীতে আনন্দের জোয়ার বহে যায়। গৃহ জীবনে সুখ দুঃখ
নিত্য সহচর। উপদেশছলে তিনি অনেক যাত্রাগানের কলি ও কবিতা আবৃত্তি করে উপস্থিত
উপাসক-উপাসিকাদেরকে ধর্মজ্ঞান লাভের জন্য উৎসাহিত করেন।
উপাসক-উপাসিকাদের পক্ষ থেকে
আমি সবার জন্য ধর্মজ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রতি প্রার্থনা জানাই। তাতে তিনি
আশীর্বাদ করে বলেন-ধর্মজ্ঞান লাভ করতে হলে কোন টাকা-পয়সার দরকার হয়না। শুধু
তিনটি জিনিষের প্রয়োজন। প্রথম চিত্তের নির্মলতা, দ্বিতীয় উচ্চ আকাংখা ও তৃতীয়
উচ্চমনা হতে হবে। যাবতীয় বাচনিক ও কায়িক কর্ম চিত্ত হতে উৎপত্তি হয়ে থাকে
সুতরাং স্বীয় চিত্তকে পরিশুদ্ধ করতে না পারলে ধর্মজ্ঞান লাভ হয় না। মানুষের
অসংখ্য আকাংখা থাকে। তন্মধ্যে নির্বাণ আকাংখাই সবচেয়ে উত্তম। নির্বাণের উপরে আর
কিছু নেই বলে নির্বাণ আকাংখাই উত্তম। অন্য আকাংখায় অধোগতি হয়। যার মান বা চিত্ত
সব সময় নির্বাণের দিকে থাকবে তিনি একদিন না একদিন নির্বাণ লাভ করতে পারবেন।
চিত্তকে নির্বাণ মুখী রাখাকে উচ্চমনা বলে।
No comments:
Post a Comment